ঢাকা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ০৯:২৩:০১

শুধু শিক্ষায় এসেই কেন থমকে যায় পদোন্নতি

| ৩১ ভাদ্র ১৪৩১ | Sunday, September 15, 2024

শিক্ষকতাশিক্ষকতাপ্রতীকী ছবিদেরিতে হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পদোন্নতির জ্যেষ্ঠতার তালিকায় যোগ্যদের নাম অন্তর্ভুক্তকরণ উদ্যোগকে নবীন কর্মকর্তারা সাধুবাদ জানিয়েছেন তবে কার্যক্রম শেষ হয়নি। অন্য ক্যাডারের ৩৬ এমনকি ৩৭তম ব্যাচ পদোন্নতি পেয়েছে কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের ৩১তম ব্যাচের অনেকেরই সুযোগ হয়নি ৬ষ্ঠ গ্রেডের যাওয়ার। ইংরেজি ‘ফার্স’-এর বাংলা সমার্থক শব্দ হলো প্রহসন। ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহাকবি ও এবং প্রহসন রচয়িতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৬০ সালে দুটি স্বার্থক প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ রচনা করেন। তাঁর জীবনকাল একবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বর্ধিত হলে তিনি হয়তো ‘একেই কি বলে প্রমোশন’ নামে নতুন কোনো প্রহসন রচনা করতেন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রহসন উচ্চ শিল্প ও সামাজিক মূল্যধারণ করলেও হালে ডিপিসি ঘেরাটোপে প্রমোশন নামক যে উচ্চমার্গীয় প্রহসনের নিয়ত মঞ্চায়ন হয়, তা শিল্প মূল্যহীন এবং শিক্ষা ক্যাডারকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হয়।ঢাকঢোল পিটিয়ে ও ফেসবুকে ঝড় তুলে অনেকে পদোন্নতির ক্রেডিট নিলেও বরাবরের মতোই বাস্তবে কোনো সুবিধাই পাচ্ছেন না পদোন্নতিযোগ্য শিক্ষা ক্যাডারের সাধারণ সদস্যরা। গত মাসে দুই ধাপে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে যথাক্রমে ২ হাজার ৬৪৭ জন ও ২ হাজার ৩৬১ জন মোট ৫ হাজার ৮ জন কর্মকর্তার নাম প্রেরিত হয়েছে। প্রভাষক পর্যায়ের প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এ অবস্থায় কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে আওয়াজ তোলা হয় যোগ্য সবার পদোন্নতির জন্য। সাত দিনের মধ্যে পদোন্নতির কার্যক্রম শুরু হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন আশ্বাসও মিলে। সর্বশেষ কবে পদোন্নতি নামক ধূমকেতুর দেখা মিলেছিল শিক্ষা ক্যাড়ারে তা প্রায় ভুলে যেতে বসেছেন কর্মকর্তারা। ক্যাডারের সদস্যরা পদোন্নতি সমস্যা সমাধানে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছেন। তারই অংশ হিসেবে গত মাসে এক তপ্ত দুপুরে শিক্ষাসচিব এবং উপদেষ্টার কার্যালয়ে ৯ দফা জমা দেওয়া হয়।

সেখানে পদোন্নতিযোগ্য সবার পদোন্নতি দাবি করা হয় এবং কথোপকথনে বিভিন্ন ব্যাচের পদোন্নতি বঞ্চনার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলা হয়, ১০-১২ বছরেও পদোন্নতি না পাওয়া শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে নিজ ক্যাডার নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। পদসোপান অনুযায়ী, এখন শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপকেরা সর্বোচ্চ চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত যেতে পারেন, যদিও অনেক ক্যাডারেই ৫ম থেকে ৩য় গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষায় ২০১৫ সালের পূর্বে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ৫ম থেকে তৃতীয় গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ ছিল, যা ৮ম পে স্কেল ঘোষণার মধ্য দিয়ে রহিত করা হয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা কর্মজীবনে তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় এবং দ্বিতীয় থেকে প্রথম গ্রেড পাওয়ার সুযোগ পান। শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা অন্য ক্যাডার, বিশ্বিবদ্যালয়ের শিক্ষক, অনেক ক্ষেত্রে নন-ক্যাডার এমনকি ব্যাংকারদের থেকেও বঞ্চিত।

বিধিবাম জুলাই বিপ্লব হয়, সরকার যায় সরকার আসে, শিক্ষায় বৈষম্য নিরসন হয় না বরং বনসাই হয়ে রয়। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অভিমানের খেয়ার মতো বলতে চাই, ‘অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই, কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই। আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন-আর কত দিন?’

 

 

 

২৭তম বিসিএসের কোনো কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেখানে এখন পঞ্চম গ্রেড পাচ্ছেন, সেখানে ১৬তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের অনেকেই পঞ্চম গ্রেডে (সহযোগী অধ্যাপক) চাকরি করে অবসরের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন। এ রকম বিভিন্ন বৈষম্যের কথা তুলে ধরে তা সমাধানের দাবি জানানো হয় আবেদনে। কিন্তু তারপরও কোনো অদৃশ্য কারণে স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না হাজারো কর্মকর্তার পদোন্নতি সমস্যার। দীর্ঘ বিরতির পর শুধুই শূন্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি দিলে অথবা যেকোনো একটি টায়ারে পদোন্নতি দিলে সমস্যার সাময়িক সমাধান মিলবে। স্থায়ী  সমাধানকল্পে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি অথবা সুপার নিউমারি পদ সৃজনের বিকল্প নেই। গত ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর থেকে  প্রায় সব ক্যাডারের ডিপিসি বসেছে, পদোন্নতির জিও হয়েছে কোন ক্যাডারে একাধিক টায়ারে পদোন্নতি হয়েছে, পদ্মা-মেঘনায় হাজারো কিউসেক জল গড়িয়েছে শত শত আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রগুলো থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছেছে কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতি ফিট লিস্ট থেকে জিও পর্যন্ত পৌঁছায়নি।শিক্ষা ক্যাডারে সর্বোচ্চ ৪ গ্রেড পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বিধায় অনেক কর্মকর্তার ইনক্রিমেন্ট দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত এই জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের উচ্চতর ডিগ্রি অধিকতর প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট মহলের গুণগত শিক্ষার প্রসারে এবং দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে চিরায়ত উদাসীনতা স্বরূপ আবারও স্পষ্ট  হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত উচ্চশিক্ষা বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকা থেকে।

শিক্ষকতা
অতলান্ত বিষাদগ্রস্ত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা যারপরনাই হতাশ। সামজিক যোগাযোগমাধ্যম স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ চোখ আটকে গেল একজনের স্ট্যাটাসে। তিনি ৩১তম বিসিএসের এক নারী কর্মকর্তা। তাঁর সাবেক রুমমেট যিনি ব্যাংকে কর্মরত তিনি প্রমোশন পেয়ে পঞ্চম গ্রেডে চলে গেছেন, শুধু তা-ই নয়, অন্য ক্যাডারে কর্মরত ব্যাচম্যাটরাও দীর্ঘদিন যাবৎ আছেন ষষ্ঠ গ্রেডে, যদিও তাঁরা প্রায় একই সঙ্গে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। তাহলে তিনি কি শুধু প্রমোশন বঞ্চিত হয়ে আছেন! তিনি যখন দেখেন, তাঁর সহকর্মীরা বোর্ড থেকে মাথায় করে পরীক্ষার খাতা বয়ে আনেন কিংবা নিজ ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে থাকা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষদের জন্য কোনো যানবাহন নেই অথচ বেতন স্কেলে অনেক পেছনে থাকা বিভিন্ন ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তারা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। যুগ্ম সচিব, উপসচিব এমনকি ব্যাংকাররাও  গাড়ি কেনার ঋণ পাচ্ছেন অথবা তিনি নিজে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হচ্ছেন অন্যরা তখন তার এমন অনুভূতিকে নিতান্তই আবেগ বলে পাশ কাটানো যাবে না। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পর  দেশের সব ইউএনওর নিরাপত্তায়  তড়িৎগতিতে সশস্ত্র আনসার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও বিভিন্ন সময় অধ্যক্ষসহ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তার ওপর হামলা হলেও পরবর্তী সময়ে এমন অনভিপ্রেত ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। করোনা-পরবর্তী  শিক্ষা  কার্যক্রম পরিচালনার তিন বছর অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু পাঠদানের প্রয়োজনীয় উপকরণ মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা ইন্টারনেট ভাতা দেওয়ার তাগিদ অনুভব করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক স্তরের পদোন্নতি। এমনিতেই ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির কারণে এই ক্যাডারের পদোন্নতির গতি স্লো। প্রায় ৩০ বছর চাকরি করার পরও অনেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি না পেয়েই অবসরে চলে যাচ্ছেন। একটানা ১৬-১৭ বছর কোনো প্রমোশন না পাওয়ারও বিরল রেকর্ডও আছে। একসময়ে মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ১৪তম এবং তাঁর অধীন কর্মরত উপাধ্যক্ষ সপ্তম বিসিএসের কর্মকর্তা ছিলেন। এমন অনেক সরকারি কলেজেই জ্যেষ্ঠদের ‘এসিআর’ লিখছেন কনিষ্ঠরা। বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির পরিবর্তে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা অনুসরণ করলে সমস্যার অনেকটা সমাধান সম্ভব। শিক্ষা ‘ভ্যাকেশন’ ডিপার্টমেন্ট  হিসেবে গণ্য হলেও এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা সরকারি কলেজে সরাসরি শিক্ষকতায় সম্পৃক্ত রয়েছেন, তাঁরা অর্জিত ছুটির আর্থিক সুবিধা থেকে বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ শনিবার এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসে যখন অন্যরা পরিবার পরিজন নিয়ে সময় কাটান, তখন তাঁদের  দায়িত্ব পালন করতে হয়।

এতে অবসরের সময় তাঁদের গড়ে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু ক্রমাগত বঞ্চনা, অপ্রাপ্তি, বৈষম্য তাঁদের ক্যাডারের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের কর্মস্পৃহাকে হ্রাস করে দিচ্ছে। তাতে নতুনমাত্রা যোগ করেছে প্রায় তিন শতাধিক  বেসরকারি কলেজ সরকারীকরণ ও এসব কলেজে কর্মরত প্রায় ১৮ হাজার শিক্ষককে আত্তীকরণ। যেখানে ক্যাডার কর্মকর্তাদের সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে যোগদান করতে প্রায় বছর খানেক লেগে যায় এবং চাকরি স্থায়ীকরণ হতে বিভাগীয় পরীক্ষা, বনিয়াদি প্রশিক্ষণের বৈতরণী পার হতে দুই বছর সময় প্রয়োজন হয়, সেখানে তাঁদের নামমাত্র পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ ছাড়াই কীভাবে স্থায়ীকরণ হয়, তা বোধ্যগম্য নয়।

শিক্ষা ক্যাডারে সর্বোচ্চ ৪ গ্রেড পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বিধায় অনেক কর্মকর্তার ইনক্রিমেন্ট দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত এই জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের উচ্চতর ডিগ্রি অধিকতর প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট মহলের গুণগত শিক্ষার প্রসারে এবং দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে চিরায়ত উদাসীনতা স্বরূপ আবারও স্পষ্ট  হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত উচ্চশিক্ষা বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকা থেকে। যেখানে এই বিদ্যাশিল্পীদের স্বল্পসংখ্যক বৃত্তি নামক অমাবস্যার চাঁদের দেখা পেয়েছেন। অথচ শিক্ষার্থীদের স্বার্থে জ্ঞানের ফেরিওয়ালাদের এই উচ্চশিক্ষা বৃত্তি লাভের সুযোগ অবারিত হওয়া উচিত ছিল।

বাস্তবে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ফলে অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট লাভের সুযোগ রয়েছে, সেটিও বেশ দুরূহ। শূন্য পদের বিপরীতে নিয়মিত পদোন্নতি যেখানে শ্রমসাধ্য, সেখানে যোগ্য সবার পদোন্নতি তো সুদূরপরাহত। শিক্ষা ক্যাডার সদস্যরা সরকার পরিবর্তন এবং শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে একজন শিক্ষক নিয়োগ পাওয়া প্রত্যাশা করেছিলেন এবার অন্তত তাঁরা বৈষম্যের শিকার হবেন না, অনান্য ক্যাডারের ন্যায় তাঁদের ৩৭তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতি লাভ করবে। কিন্তু বিধিবাম জুলাই বিপ্লব হয়, সরকার যায় সরকার আসে, শিক্ষায় বৈষম্য নিরসন হয় না বরং বনসাই হয়ে রয়। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অভিমানের খেয়ার মতো বলতে চাই, ‘অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই, কিছুটা তো চাই, কিছুটা তো চাই। আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন-আর কত দিন?’

*লেখক: সচিব তালুকদার, প্রভাষক (রসায়ন), ৩৬তম বিসিএস