ঢাকা, মে ৭, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ০৯:১০:৫৬

মৃত্যুঞ্জয়ী মনোরঞ্জন ঘোষাল

| ৩ কার্তিক ১৪২৩ | Tuesday, October 18, 2016

Image may contain: 1 person, outdoor and close-up

সংগীত সত্য সুন্দর কল্যাণ ও আনন্দের কথা বলে। সুরের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে শিল্পী শ্রোতাদেরকে নিয়ে যান এক মোহাবিষ্ট অনিন্দ্যসুন্দর জগতে। জাগতিক হাসি – কান্না, সুখ- দু:খসহ মানবমনের বিচিত্র অনুভূতির সাবলীল সুরেলা প্রকাশের নামই সঙ্গীত। আর এই সঙ্গীতকে ধারন করে তিনি আজ জীবন্ত কিংবদন্তি – তিনি হলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিশিষ্ট্ কন্ঠ শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল। সঙ্গীত শিল্পী ছাড়াও তিনি একাধারে সাংবাদিক, সুবক্তা, সুরকার ও টেলিভিশন উপস্থাপক।
৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১ এর অসহযোগ আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধেও অগ্নিঝরা দিনগুলোতে যিনি স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ইথারে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উজ্জীবনী সঙ্গীত তিনিই হলেন মনোরঞ্জন ঘোষাল। ১৯৪৭ এর ১ মে ( সার্টিফিকেট অনুসারে, ৫ ই অক্টোবর ১৯৪৮) তিনি সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার গোনালী নলতা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। বাবা প্রয়াত যামিনীকান্ত ঘোষাল ছিলেন বাংলাদেশ পাবলিশার্স – এর কর্ণধার এবং মা কমলা ঘোষাল। কপিলমুুণি সহচরী বিদ্যামন্দির থেকে ১৯৬৩ সালে এস.এস.সি, ঢাকা জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট (৬৫), বি.কম (৬৭) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে এম.কম পাস করেন।১৯৬৭সালে বি.কম পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. বি. এ. ভর্তি হন। কিন্তু সঙ্গীত চর্চার অসুবিধার কারনে তিনি এম. বি. এ থেকে এম.কম ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে তিনি বেতার ও টেলিভিশনে নজরুল সঙ্গীত ও আধুনিক বাংলা গান গাওয়া শুরু করেন।

১৯৬৯ সালে তিনি তৎকালীন সুপরিচিত সংগঠন স্বরবিতান শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি নির্বাচিত হন। ছাত্র জীবন থেকেই বিভিন্নমুখী প্রতিভার অধিকারী মনোরঞ্জন ঘোষাল দৈনিক/ সাপ্তাহিক পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন । তার প্রকাশিত উপন্যাসগুলো হলো: ‘দেনা পাওনা’ ‘আশায় বাঁধে ঘর’ ‘ শেষ পরিচয় ’ ‘ প্রেম ও প্রয়োজন’ এবং ‘একান্ত আমি’ ইত্যাদি। এই সময়ে তার সম্পাদিত প্রবন্ধ সংকলন ‘কলরব’ও ‘স্বরবিতান’ বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। ১৯৬৪ সালের হিন্দু- মুসলিম দাঙ্গায় ঢাকার জগন্নাথ কলেজে আশ্রিত অসংখ্য হিন্দুদের দেখাশুনার বিষয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৬৬‘র ছ‘দফা ও ৬৯ – এর গণ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাব্ েঅংশ গ্রহণ করেন। এরই মধ্যে ২৬ শে মার্চ মনোরঞ্জন ঘোষালের বড় ভাই রতন কুমার ঘোষালকে ঢাকায় ৫১ নম্বর শাঁখারী বাজারের বাসায় পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। ছোটভাই মদনমোহন ঘোষাল গ্রামের বাড়িতে শহীদ হন। সাইকেল চালিয়ে কলকাতা গিয়ে বাবা মাকে খুঁজে না পেয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন মদনমোহন। কপিলমুণির রাজাকাররা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে কপোতাক্ষ নদে ফেলে দেয়। ৭১ এর ২৮ মার্চ সদরঘাট টার্মিনালে তাকে পাকিস্তানী সেনারা আটক করে জেরা করে এবং কিছুক্ষণ পরে ছেড়ে দেয়।

৭১ এর ৩১ শে মার্চ খানসেনাদের হাত খেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ঢাকা সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুলে আশ্রয় নেয়া অনেক হিন্দু পরিবারকে দেখতে যেয়ে তিনি পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাক বাহিনী তাহেসহ ৩৩ জনকে আটক করে জগন্নাথ কলেজের ২৩ নং রুমে আটকে রাখে। এই সারাদিন আটক থাকা অবস্থায় কোন পানীয় বা খাবার তাদের দেওয়া হয়নি। এর পর সন্ধ্যা ৭ টায় ১১ জন করে হাত ও চোখ বেঁধে সবাইকে নিয়ে যায় পুরাতন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান ও শাঁখারী বাজার মোড়ে। এ সময় টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। এখানেই প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের ২২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয় যার শব্দ কলেজের ঐ রুম থেকেই তিনি শুনতে পান। তারপর তৃতীয় ব্যাচের ১১ জনকেও একইভাবে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তিনি শুধু শুনেন ঠাস ঠাস গুলির শব্দ ও সেনাদের বুটজুতার ভারী শব্দ। পরে পাকিস্তানী সেনারা এই ৩৩ জনকে জজকোর্টের ভিতরে একটি বড় গর্তে এলোমেলোভাবে এই ৩৩ জনকে মেরে ফেলে মাটি চাপা দেয়। মনোরঞ্জন ঘোষাল গায়ে চিমটি কেটে বুঝতে পারেন যে তিনি বেঁচে আছেন। তিনি দাঁত দিয়ে হাতের বাঁধন ও পরে চোখের বাঁধন খুলে ফেলেন। এতে তার সময় লাগে প্রায় ১১ ঘন্টা। গুলীতে সবাই মারা গেলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান মনোরঞ্জন ঘোষাল। এর পর বিস্তর বিপদশংকুল পথ পেরিয়ে সীমান্ত পার হয়ে মেঘালয় হয়ে পশ্চিম বাংলার কলকাতায় পৌঁছান।

কলকাতার ৯ নাম্বার সার্কাস এভিনিউতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাই কমিশনে প্রথমেই মন্টু ভাই অর্র্থাৎ প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও তৎকালীন ঢাকার টেলিভিশনের কর্মকর্তা মোস্তফা মনোয়ার- এর সাথে দেখা হয়। তার কাছ থেকে টেলিফোন নম্বর নিয়ে ফোন করলে প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আব্দুল জব্বারের সাড়া পান। আব্দুল জব্বার তাকে রাস্তার বর্ণনা দিয়ে তার কাছে যেতে বলেন। এভাবেই তিনি ৫৭/৮ বলিগঞ্জ সার্কুলার রোড়, কলকাতা -৭০০০১৯ – এ অবস্থিত স্বাধীনবাংলা বেতার ভবনে পৌঁছান, যদিও তখনও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কলকাতায় চালু হয়নি। ২৫ মে ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হলে তিনি এই কেন্দ্র থেকে এবং পাশাপাশি অতিথি শিল্পী হিসেবে আকাশবাণী কলকাতায় সঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকেন। এসময় বাংলাদেশ সরকারের সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

কর্মজীবনে মনোরঞ্জন ঘোষাল ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, সোনারগাঁও হোটেল ও আলফা গ্রুপে জনসংযোগ বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাপ্তাহিক ছুটি ও ইংরেজি সাপ্তাহিক দি হেরাল্ড পত্রিকায় সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাপ্তাহিক ইংরেজি টাইড পত্রিকায়ও কুটনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক মাতৃভূমি ও দি ফিন্যান্সিয়াল মিরর- এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও দি বিডি টাইমস্ টোয়েন্টিফোর ডটকম- এর সম্পাদক। তিনি বহু সংখ্যক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত: চেয়ারম্যান, হিন্দু হেরিটেজ ফাউন্ডেশন; সিনিয়র ভাইস চেযারম্যান, ন্যাশনাল ফ্রিডম ফাইটার্স ফাউন্ডেশন; সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ টেলিভিশন শিল্পী সংস্থা; মহাসচিব, ইন্টার রিলিজিয়ান হারমনি সোসাইটি (আই.আর.এইচ.এস), বাংলাদেশ ইন্ডিয়া সিটিজেন সোসাইটি (বি.আই.সি.এস); উপদেষ্টা, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট ও বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংস্কার সমিতি।

তিনি বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থেকে স্বর্ণ পদক, সম্মাননা, ক্রেস্ট ও সাইটেশন পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে সুভাষিনী কলেজ, তালা, সাতক্ষীরা, রোটারী ক্লাব মতিঝিল, চয়ন সাহিত্য ক্লাব স্বর্ণ পদক, কমিটমেন্ট, জয় বাংলা শিল্পীগোষ্ঠী, আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী, গ্রামীণ ফোন, হক্কানী মিশন, স্বাধীনতা একাডেমী, এশিয়ান কালচারাল সোসাইটি, বাংলাদেশ দলিত পরিষদ, গীতালী ললিতকলা একাডেমী, রুরাল জার্নালিষ্ট ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, খুলনা সোসিও কালচারাল এসোসিয়েশন, গণসংগীত সমস্বয় পরিষদ, বাংলার মুখ, বগুড়া, ইষ্টার্ণ কমান্ড অব ইন্ডিয়া , বিশুদ্ধানন্দ শান্তি স্বর্ণ পদক-২০১৫।

তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। স্ত্রী সন্ধ্যা ঘোষাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম.এ। মেয়ে ছন্দা ঘোষাল ঢাকার একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন, বর্তমানে এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার করছেন। ছেলে মানবেন্দ্র ঘোষাল প্যারিসে থাকেন।
মনোরঞ্জন ঘোষাল নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক বাংলা গান ও দেশাত্মবোধক গান ও টকশো পরিবেশন করে থাকেন। একাধিকবার বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে তার জীবনভিত্তিক সাক্ষাতকার ও সঙ্গীত প্রচারিত হয়েছে। ভারত সরকারের ইষ্টার্ণ কমান্ড তাকে ২০০৫ সালে ফোর্ট উইলিয়ামে লাল গালিচা সংবর্ধনা প্রদান করেন। এছাড়াও তিনি দেশে বিদেশে অসংখ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংবর্ধিত হয়েছেন। নব্বই দশকের প্রথম দিকে নেপাল বাংলাদেশ ব্যাংক স্থাপনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন।
একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে গেলে যে সকল গুণাবলী থাকা দরকার অধিকাংশই শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষালের মধ্যে বিদ্যমান। দেশপ্রেম তার এবং তার পরিবারের মধ্যে বেঁধেছে এক পবিত্র বন্ধন। কোন লোভ বা মাতৃভূমিকে ভুলে পরদেশ প্রবাসী হওয়ার মত হীনপ্রবৃত্তি তার মধ্যে কাজ করেনি বলেই তিনি একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক হতে পেরেছেন। যে মাটিতে লাখো শহীদের রক্তের চিহ্ন দৃশ্যমান সে – রক্তের ঋণ শুধতে আজও তিনি গেয়ে চলেছেন জনতার মুক্তির গান, বলে চলেছেন শান্তির কথা, সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা। তিনি বিশ্বাস করেন সৃষ্টিকর্তা মানব কল্যাণের জন্যই ধর্মের সৃষ্টি করেছেন। শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল আমাদের আত্মার আত্মীয়। এ আত্মীয় আদর্শের, এ আত্মীয় একসাথে একাত্ম হয়ে মানব মুক্তির সার্বিক সংগ্রামে কাঁধে কাঁধ রেখে পথ চলার।
বদরু মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান মনোরঞ্জন ঘোষালের জীবনীকার। তার লেখা সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় প্রকাশিত মনোরঞ্জন ঘোষালের জীবনী’র অংশবিশেষ এখানে সংকলিত করা হয়েছে।