প্রতীকী ছবি।
দেশে প্রতারণার হার অনেক বেড়েছে। এমন কোন খাত নেই যেখাতে প্রতারকরা তাদের জাল বিস্তার করেনি। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ জনগণ। জমিজমা বেচাকেনা, ব্যাংকিং লেনদেন, অনলাইনে পণ্য বিক্রি, চাকরির প্রলোভন, বিয়ে, তন্ত্রমন্ত্র সাধনার নামে সিদ্ধিলাভ, অর্থ দ্বিগুণ করে দেয়াসহ নানা বিষয়ে প্রতারণা চলছে।
কোন কোন পর্যায়ে ভুক্তভোগীরা প্রতিকার পেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অপরাধের প্রতিকার মেলে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে প্রতারকরা বেরিয়ে যাচ্ছে। আইন কঠোর করে প্রতারণাকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে নির্ধারণ না করলে এ ধরনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে।
গত কয়েকদিনে বিভিন্ন প্রতারণার ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব ঘটনা অর্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যে কয়েকটি প্রতারণার ঘটনায় ব্যবস্থা নিয়েছে তার অধিকাংশই হচ্ছে, প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া। একসময় এগুলো দুএকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকলেও এখন তা ওপেন সিক্রেট। এমনও দেখা গেছে, প্রতারণা করে জেলে গিয়ে জামিন পেয়ে আবারো প্রতারণা শুরু করেছে প্রতারক। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতারকরা তাদের প্রতারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। রীতিমত অফিস খুলে তারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় তাদের কর্ম সারছে। কেউ প্রতারিত হয়ে অভিযোগ করলে হয়তো তাদের আইনের আওতায় আনা হয়। কিন্তু এর আগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। অপরদিকে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যকেও প্রতারক-চক্রের সাথে মিলে যেতে দেখা যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু মাত্র আইনের দুর্বলতা এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৈথিল্যের কারণে প্রতারকদের প্রতাপ বাড়ছে। বর্তমানে অনেক প্রতারণার ক্ষেত্রে বিদেশীরাও জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে আফ্রিকান নাগরিকরা রাজধানীসহ সারাদেশে দোর্দণ্ড প্রতাপে তাদের প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতারণা নেই কোন খাতে?
আপনি রাজধানীর ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন প্রফুল্ল চিত্তে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আপনার চিন্তার হয়ে যেতে পারে। প্রতারকচক্র আপনার সর্বর্স্ব খুইয়ে নিতে পারে। রাতে বাসায় ঘুমাচ্ছেন? হঠাৎ জ্বিনের বাদশাহ নাম দিয়ে আপনাকে ফোন দেবে। আপনাকে কলস ভর্তি স্বর্ণের লোভ দেখাবে। কথা চালিয়ে গেলেন তো ধরা খেলেন। কারণ আপনি আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়বেন। হঠাৎ কাস্টমস অফিসারের নাম দিয়ে আপনার কাছে ফোন আসবে। বলবে আপনার নামে দামী উপহার এসেছে। টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে বলবে। আবার হঠাৎ টেলিফোনে এসএমএস দিয়ে বলবে, আপনার টাকা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। লোভে পড়ে আপনি তাদের প্রতিষ্ঠানে টাকা জমা রাখলেন। কয়েকদিন পরে দেখবেন আপনার টাকার সাথে সাথে তাদের অফিসও হাওয়া।
আবার কিছু স্মার্ট প্রতারক আছেন যারা আপনাকে বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখাবে। আপনি সরল বিশ্বাসে তাদের হাতে টাকা তুলে দেবেন। শেষ পর্যন্ত দেখবেন চাকরিটি হয়নি। একদল লোক আপনাকে ঋণ পাইয়ে দেয়ার কথা বলবে। আপনি মোটা অংকের টাকা দেবেন। পরে দেখবেন ঋণ তো পাননি, উল্টো আপনার পকেটের টাকা সব গেছে। এরকম আরো উদাহরণ দেয়া যাবে প্রতারণার। তবে সাম্প্রতিককালে বিয়ে শাদির ঘটনাতেও প্রতারণার জাল বিস্তার হয়েছে। পত্র পত্রিকায় পাত্র-পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে মাঠে নামে প্রতারক চক্র। এসব ক্ষেত্রে বিয়ের বদলে কষ্টটাই জুটছে বেশি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রতারণা যেন একটি পেশা। তাদের কোন দোষ নেই। সতর্ক থাকতে হবে আপনাকেই।
কী করলে হবে প্রতারণা
সাদামাটা অর্থে কেউ কারও সঙ্গে কোনো বিষয়ে যদি যেকোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং কোনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, সে ক্ষেত্রে প্রতারণা বলা হলেও আইন অনুযায়ী প্রতারণার সংজ্ঞা কিছুটা ভিন্ন। আইন অনুযায়ী যে ব্যক্তি, কাউকে ফাঁকি দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে বা অসাধুভাবে কোনো ব্যক্তির কাছে কোনো সম্পত্তি প্রদানে বা রাখতে প্ররোচিত করে, তাহলে হবে প্রতারণা। ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারিত ব্যক্তিকে এমন কোনো কাজ করতে বা তা করা থেকে বিরত থাকতে প্ররোচিত করে। যার ফলে ব্যক্তির শরীর, মন বা সম্পত্তির ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেটি প্রতারণা হবে। যদিও আইনে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
প্রতারণার আবার রকমফের আছে। যেমন ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে প্রতারণা, জালিয়াতি করে প্রতারণা, মিথ্যা পরিচয় প্রদান করে প্রতারণা, বিয়ে নিয়ে প্রতারণা প্রভৃতি। আলাদা আলাদা প্রতারণার অভিযোগে আলাদা আলাদা শাস্তি নির্ধারিত আছে। সাধারণত দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় মামলা বেশি হতে দেখা যায়। এ ধারায় শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং পাশাপাশি অর্থদণ্ডেরও বিধান আছে।
প্রতারণা থামছে না কেন?
আইন আছে, শাস্তির বিধান আছে তারপরও থামছে না প্রতারণা। কিন্তু কেন, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক এ বিষয়ে ইত্তেফাককে বলেন, সাধারণত: প্রতারণার মামলাগুলো অত্যন্ত দূর্বল। আমাদের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। অর্থনীতিতে নতুন নতুন খাত সৃষ্টি হয়েছে। এখন অপরাধের মাত্রাও ভিন্ন। তিনি বলেন, প্রতারণার শাস্তির জন্য যুগোপযোগী আইন করতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেছেন, উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতারণা বেড়েছে। মানুষের মধ্যে লোভ-লালসাও বেড়েছে। তবে এটি নিয়ন্ত্রণে যে কাঠামো রয়েছে সেটি দূর্বল। সেটিকেও যুগোপযোগী করতে হবে। তিনি বলেন, প্রতারকের বিরুদ্ধে মামলা করলে উল্টো ভিকটিম হয়রানির শিকার হন। এটি বন্ধ করতে হবে।
সিআইডি প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেছেন, তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। প্রতারক জানে তার শাস্তি কি হবে। শাস্তির মেয়াদ না বাড়ানো গেলে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। প্রতারণাকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করারও সুপারিশ করেন তিনি।