ঢাকা, মে ২, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ০৬:২০:৫৩

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করবেন কিভাবে

| ৪ পৌষ ১৪২৩ | Sunday, December 18, 2016

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করবেন কিভাবে

প্রতিদিন মানুষ তিন প্রকার খাদ্য গ্রহণ করে থাকে - ফ্যাট, প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট। এই ৩টি উপাদানের মধ্যে ফ্যাট সর্বোচ্চ শক্তি দান করে
(৯ ক্যালরি/গ্রাম)। আমরা গড়ে প্রতিদিন ৪০০ গ্রাম ফ্যাট, ১০০ গ্রাম প্রোটিন ও ১০০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করি। ফ্যাট বা স্নেহ বা চর্বি জাতীয় দ্রব্যকে মানব দেহের শত্রু ভাবা হলেও দেহের গঠন ও স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ফ্যাটের ভূমিকা অনন্য।
ফ্যাট বা স্নেহ বা চর্বি জাতীয় দ্রব্যের ১. দেহের গঠনে সহায়তা করা।
২. দেহের গড়ন রক্ষা করা।
৩. দেহের প্রতিটি কোষে আবরণ তৈরী করা।
৪. দেহের নিয়মিত কাজে সহায়তা করা।
৫. দেহের খাদ্য ও শক্তি ভার হিসাবে কাজ করা।
৬. দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে সঠিক অবস্থানে ধরে রাখা।
বিভিন্ন রোগে স্নেহ/
চর্বি পদার্থের ভূমিকা
স্নেহ জাতীয় পদার্থ দেহের জন্য অত্যাবশ্যক। কিন্তু পরিমাণে বেশি হলেই বিপর্যয় ঘটে। দেহ খাদ্যের মাধ্যমে যে স্নেহ পদার্থ গ্রহণ ও কাজ করে তা খরচ করায় বৈষম্য হলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। গড়ে আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্য খাই তার মধ্যে ১৫% ফ্যাট থাকে। এই ফ্যাট খাদ্যনালীতে বিপাকের পর রক্ত সংশোধনের পর লিভারে যায়। লিভারে কিছু পরিবর্তনের পর আবার রক্তনালী দিয়ে দেহের বিভিন্ন কোষে পৌছে। দেহের সব চর্বি বা কোলেস্টেরল  আমরা খাবারের মাধ্যমে পাই না। কোলেস্টেরল চর্বি জাতীয় একটি পদার্থ, মাত্র ৩০% কোলেস্টেরল আসে খাবার থেকে, বাকী ৭০% আসে লিভার থেকে। কোলেস্টেরল প্রধানতঃ চার ধরণের হয়ে থাকে। এর মধ্যে একমাত্র এইচডিএল মানব দেহের জন্য উপকারী। অন্যগুলো (এলডিএল, টিজি ও ভিএলডিএল) লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশী করে থাকে।
এইচডিএল-
একমাত্র দেহবান্ধব কোলেস্টেরল হচ্ছে এইচডিএল। ভাল বা ভদ্র কোলেস্টেরল হিসাবেও এর পরিচিতি রয়েছে। শরীরের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল ধরে ধরে লিভারে নিয়ে যায়। লিভারে গিয়ে কোলেস্টেরল ভেঙ্গে যায়। এইচডিএলের পরিমাণ যত বেশী হূদরোগের ঝুঁকি তত কম।
এলডিএল-
এলডিএল লিভার থেকে রক্তনালী ও অন্যান্য অংশে কোলেস্টেরল নিয়ে যায়। অতিরিক্ত কোলেস্টেরল রক্তনালীতে জমে জমে প্লাক তৈরী করে। এই প্লাক পর্যায়ক্রমে রক্তনালীকে বন্ধ করে দেয়। তখনই হার্ট এ্যাটাক হয়। তাই হার্ট এ্যাটাকের মত জটিল ও জীবন সংহারি অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে হলে এলডিএল (LDL) কমাতে হবে।
ট্রাইগ্লিসারাইড-
ট্রাইগ্লিসারাইড খাবার থেকে শক্তি সংগ্রহ করে জমা রাখে। স্থূলতা, শ্রমহীনতা, ধূমপান, মদ্যপান এবং অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
কোলেস্টেরল-এর উত্স-
বিভিন্ন বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে ভুল তথ্য দিয়ে মানুষকে অহরহ প্রতারণা করা হচ্ছে। ভোজ্য তেলের বিজ্ঞাপনে খুব গর্ব করে বলা হচ্ছে এই তেল কোলেস্টেরল মুক্ত। অথচ প্রাণীদেহ ছাড়া অন্য কোথাও কোলেস্টেরল তৈরী হতে পারে না। আমাদের দেহের মধ্যে যতটুকু কোলেস্টেরল   আছে তার ৭০% আমাদের লিভার থেকে আসে, বাকী ৩০% অন্যান্য প্রাণীজ উত্স (মাছ, মাংস, ডিম, লিভার, মগজ, গিলা ইত্যাদি) থেকে আসে। গাছ থেকে কোলেস্টেরল আসে না।
রোগের সাথে কোলেস্টেরলের সম্পর্ক-
অতিরিক্ত এলডিএল বা কম এইচডিএল বা বেশী  ট্রাইগ্লিসারাইড থাকলে কিছু কিছু জটিল রোগ হতে পারে। আবার কিছু রোগের জটিলতা বৃদ্ধি পায়। যেমন-
ইসকেমিক হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ফেইলুর, শ্বাসকষ্ট এবং
সন্তানহীনতা ইত্যাদি
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে যা করতে হবে-
ক) জীবন যাত্রার পরিবর্তণ
খ) পরিমিত ওষুধ গ্রহণ
ক) জীবন যাত্রার পরিবর্তণ
১. দৈহিক ওজন আদর্শ মাত্রায় রাখতে হবে। ৫-১০% দৈহিক ওজন কমালে কোলেস্টেরল মাত্রা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে যায়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চিত্তে পরিকল্পনা করে অন্যান্য প্রক্রিয়ার সাথে ওজন
কমানোকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিতে হবে। পরিমিত খাবার গ্রহণ ও দৈহিক পরিশ্রম ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ওজন আদর্শ মাত্রায় আনতে হবে। মাসে ২ কেজি পর্যন্ত ওজন কমানোই যথেষ্ট। ৫ ফুট উচ্চতার জন্য আদর্শ ওজন হচ্ছে ৫৫ কেজি। প্রতি ইঞ্চি উচ্চতা পরিবর্তনে ২ কেজি ওজন হ্রাস বা বৃদ্ধি পেতে পারে।
২. স্বাস্থকর খাবার খেতে হবে-
খাদ্যতালিকা থেকে যেসব খাবার বাদ দিতে হবে বা খুব কম খেতে হবে
- ফাষ্ট ফুড (বার্গার, পেটিস, হটডগ, রোষ্ট মাংস ও চকোলেট)
- ননিযুক্ত দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী।
- গিলা, কলিজা, মাথা, ডিমের কুসুম।
- লাল মাংস (গরুর গোস্ত)।
- প্যাকেটজাত মাছ, মাংস ও ভাত।
- বিস্কুট, চিজ ও কেক।
- প্যাকেট জুস, কোলা ও মাখন।
- সাদা চাল, সাদা আটা ও সাদা চিনি।
যেসব খাবার খেতে হবে-
শাক সবজি, টমেটো, সসা, খিরা, কপি, সালাদ ও গাজর, লাল চাল ও লাল আটা, সামুদ্রিক মাছ ও ইলিশ মাছ।
৩. নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক শ্রম-
চিকন-মোটা নির্বিচারে প্রাপ্ত বয়স্ক সবাইকে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ব্যায়াম করতে হবে। চিকিত্সকের পরামর্শক্রমে প্রতিদিন অন্ততঃ ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। হাটা, হালকা ব্যায়াম, সাতার কিংবা যোগব্যায়াম যেভাবেই হোক ব্যায়াম করতেই হবে। সুবিধামত খেলাধুলা করা যাবে।
কিছু সহজ কাজ করা যায়-
lখাবারের পূর্বে ৫-১০ মিনিট হাটাহাটি করা।
lলিফ্ট ব্যবহারের পরিবর্তে মাঝে মাঝে সিঁড়ি ব্যবহার করা।
lদীর্ঘ সময় বসে না থেকে মাঝে মাঝে হাটাহটি ও  হাত-পা নাড়াচাড়া করা।
lবাইসাইকেল বা ফিক্সড সাইকেল চালানো, রাতে কম খাওয়া।
৪. ধূমপান, মদ্যপান না করা বা ত্যাগ করা- ধূমপান এবং মদ্যপান করা যাবে না। এসব বদ অভ্যাস থাকলে আজই ত্যাগ করুন।
৫. সামাজিক জীবন যাপন-
সামাজিক জীবন যাপন সুস্বাস্থের জন্য সহায়ক। প্রতিমাসে কমপক্ষে চারদিন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা উচিত্। সামাজিক কর্মসূচীতে হাটাহাটি ও আলোচনার সুযোগ থাকে। দৈহিক ও মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকার পাশাপাশি ক্যালরি খরচও হয়।
৬. ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণ-
ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চললে মানুষের জীবন ছন্দময় হয়। পরিমিত খাবার গ্রহণ, পরিশ্রম, জ্ঞান অর্জন, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা এবং পরোপকার ইত্যাদি শিক্ষা আমরা ধর্ম থেকেই পেয়ে থাকি যা পারিবারিক ও সামাজিক চর্চায় বিস্তৃতি লাভ করে। পরিমিত খাদ্য গ্রহণ কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের অন্যতম উপায়।
খ) পরিমিত ওষুধ গ্রহণ-
জীবন যাত্রার পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রয়োজন হলে চিকিত্সকের পরামর্শক্রমে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিমিত ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। সাধারনতঃ দীর্ঘ সময় ওষুধ খেতে হয়। চিকিত্সকের সাথে যোগাযোগ রেখে ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে।
শেষ কথাঃ
মানুষের জীবনকাল সীমিত। এই নির্দিষ্ট ও পূর্বনির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব দায় দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হয়। মানব জীবনের মিশণ সফলভাবে শেষ করার জন্য দৈহিক ও মানসিক সূস্থতা প্রয়োজন। সূস্থতার জন্য কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক মাত্রায় রাখতে হবে। জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এবং সেই সাথে প্রযোজ্যক্ষেত্রে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গতিময়তার জন্য জীবনযাত্রার পরিবর্তন ধারাবাহিকভাবে চালাতে হবে। আদর্শ জীবনের কোন বিকল্প নেই।