ঢাকা, মে ৭, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ০১:১৭:৪৫

আসছে বছর আবার হবে: এক আমোদগেঁড়ের আশাবাদ

| ২৯ আশ্বিন ১৪২৩ | Friday, October 14, 2016

Durga puja

সারা বছর এই চারটে দিনের জন্য অপেক্ষা করে থাকা। না, এমনটা আর বলা যাবে না। পুজো আর মোটেও চারদিনের নেই। কম সে কম পনেরো দিনের তো বটেই।

‘গণপতি বাপ্পা মোরিয়া’। বছর কয়েক আগেও বাঙালির কাছে এই স্লোগান ছিল বিজাতীয়। কিন্তু এখন বাঙালিও গণেশবাবাজির ভক্ত। ঘরের কোণ থেকে বাজারের মোড়— সর্বত্র সাড়ম্বরে পূজিত হয়েছেন গণপতি বাপ্পা।

কেনই বা হবে না! বাঙালি তো এখন ধনতেরসকেও নিজের করে নিয়েছে। বঙ্গভাষীরা শুধু ছট পুজোটাকেই এখনও কবজা করতে পারেনি। আসলে, ছট পুজোয় আড়ম্বরের থেকে আয়োজন অনেক বেশি। নিয়মকানুনের অনেক ধাক্কা। কিন্তু সেভাবে ‘ছট ঠাকুর মাঈ কী জয়’ নেই।

বাঙালির চাই মস্তির উৎসব। আর তার জন্য সারা বছরে পার্বণের কমতি নেই। পয়লা বৈশাখ দিয়ে শুরু আর চৈত্র সংক্রান্তি দিয়ে শেষ। ইংরাজি ধরলে হ্যাপি নিউ ইয়ার থেকে, ক্রিসমাস। সারাটা বছর কেক, ফুচকা, পুষ্পাঞ্জলি, খাসি, উপোস, ফোঁটা…

উৎসব আর উৎসব। এখন সেই উৎসবকে আরও আরও বড় করে দিতে মরিয়া সরকার। বাঙালির বসন্তোৎসব ছিল, মাটি উৎসব ছিল না। বাঙালির বইমেলা ছিল, আহারে-বাংলা মেলা ছিল না। মা-মাটি-মানুষ আমোদের ভাণ্ডার ভরে দিয়েছে। না, এখানেই শেষ হল না। ট্রেনের চিরুনিওয়ালা হকারের ঢং-এই সরকার যেন বলছে, ‘এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। সবকটি উৎসবের সঙ্গে এবার থেকে আপনারা ফ্রিতে পাবেন সরকারি-বিসর্জন পরব।’ শুরু হল ২০১৬ সালে। ইতিহাসে লেখা থাকবে ১৪ অক্টোবর, শুক্রবারের কথা। এই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজোর পরেও দুর্গাপুজো। রাজপথ রেড রোডে মা দুর্গার ‘কুচকাওয়াজ’। আসছে বছর আবার হবে। হতেই থাকবে, হতেই থাকবে…

অনেকে বলেন, ‘আসছে বছর, আবার হবে’— এই ধ্বনি নাকি বাঙালির আশাবাদের নিদর্শন। কিন্তু ইদানীং-এর এক্সটেনডেড ফেস্টিভ্যাল দেখে মনে হয়, বাঙালি আসলে এক আমোদগেঁড়ে প্রজাতির প্রাণী। আর এই ‘আবার হবে’ ধ্বনি আমোদগেঁড়েদের হাম্বারব।

দুর্গাপুজো বরাবর ছিল চারদিনের। আগে নবমী নিশি চোখে জল আনত। পোহাইলে নবমী নিশি উমা যাবে কৈলাসে। কিন্তু না, এখন নবমী নিশি চোখে নয়, জিভে জল আনে। পুজো তো শেষ হচ্ছে না। একাদশী থেকেই তো কম ভিড়ে সেরা পুজো দেখার উৎসব শুরু। উমাকে এখন যেন ঘাড় ধরে বিদায় করতে হয়। এক্সটেনডেড ছুটি ভোগ করে এ বার লক্ষ্মী আসার আগের দিনে পাকাপাকি কৈলাস যাত্রা হল কলকাতা শহরে আসা উমাদের। তাও এক নতুন উৎসব উপহার দিয়ে। সৌজন্যে— রাজ্যের ‘উৎসব’ সরকার।

মহালয়ার দিনে মুখ্যমন্ত্রী কলকাতার একটি মণ্ডপে উপস্থিত হয়ে কার্যত শহরের পুজোর সূচনা করে দিয়েছিলেন। মন্ত্রীরা তখন নিজ নিজ মণ্ডপে পুজো নিয়ে মেতে। দফতরে ছুটি। হলিডে মুড তৃণমূল ভবনেও। মহালয়ার পরের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় ঠাকুর দর্শন। আর শেষটা হল একেবারে পূর্ণিমার আগের দিন। মানে পুরো এক পক্ষকালের পুজো। এর আগে এত বড় শারদীয়া পায়নি বাংলা। আগামীবার নিশ্চয়ই আরও বড় হবে দুর্গার বাপেরবাড়ি থাকার মেয়াদ। ক্রমশ বড় হয়ে ওঠাই তো উৎসবের ধর্ম। মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ…।

পঞ্জিকা আর পাত্তা পায় না। এখন নতুন দিনের স্লোগান— ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ? সরকার রাখবে যতক্ষণ।’ বিসর্জন তো প্রতীকী। উৎসবের কোনও বিসর্জন নেই। এবার লক্ষ্মী। পিছনেই কালী, ভাইফোঁটা, ছট, জগদ্ধাত্রী সঙ্গে কার্তিক। সুতরাং, ছুটি-ছুটি-ছুটি।

এ বছর তো পঞ্চমীতেই ছুটি পড়েছে রাজ্য সরকারের। কিন্তু মহালয়ায় পুজো উদ্বোধন মানে সেদিন থেকেই তো মন ছুটি পেয়ে গিয়েছিল। তারও আগে, কেনাকাটা, পুজোর বিজ্ঞাপন, খুঁটি পুজো-সহ এটা-সেটা নিয়ে মন ছুটিতেই ছিল। বকেয়া ডিএ নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। এসএসসি পরীক্ষা কবে হতে পারে তা মাথাতেও ছিল না। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, ষষ্ঠ বেতন কমিশন, রাজ্যে শিল্প স-অ-ব প্রশ্ন ছিল শিকেয় তোলা। উৎসব আরও চলুক। আরও কিছু দিন ভুলে থাকা যাবে অপ্রাপ্তির কষ্ট। সরকার ভাবছে, মন্দ কী!

তাই পুজোর ছুটি বাড়বে। আরও বড় হবে। কয়েক বছর আগেই কলকাতার এক গণেশ পুজো উদ্বোধন করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, আগে বিশ্বকর্মা পুজো থেকে শুরু হতো বাঙালীর শারদীয়া এখন গণেশ পুজো থেকে। বাঙালির মুখ্যমন্ত্রীর মুখের কথাতেই তো স্পষ্ট বাঙালি কতটা আমোদগেঁড়ে হয়ে উঠেছে।

সেই আশাবাদই বলছে, আগামী হয়ে উঠবে আরও আমোদের। আরও আনন্দের। আরও বড় হবে পুজোর ছুটি।