ঢাকা, এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১০:৪৯:১৬

অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার ও অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বাড়ছে

| ২ শ্রাবণ ১৪২৪ | Monday, July 17, 2017

বাংলাদেশে বছরে ৩ লাখের বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে। প্রয়োজন না থাকলেও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে, রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে। রোগ শনাক্তকরণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু এসব পর্যবেক্ষণে বা নিয়ন্ত্রণে দেশে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট বলেছে, বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাসেবায় ওষুধ, অস্ত্রোপচার এবং রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অতি ব্যবহার হচ্ছে। অপ্রয়োজনীয় সেবা রোগীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে। এসবের কারণে রোগীর ব্যক্তিগত খরচ যেমন বাড়ে, তেমনি স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করা সম্পদের অপচয় হয়। সাময়িকীটি চিকিৎসাসেবার অতি ব্যবহার নিয়ে গত ৮ জুন চারটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে।

ল্যানসেট বলেছে, চিকিৎসাসেবার অতি ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নেই এবং এটা পরিমাপ করা কঠিন। এ বিষয়ে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে কিছু গবেষণা হয়েছে। তবে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতেও যে অতি ব্যবহার বাড়ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

সন্তান প্রসবে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সব সন্তান প্রসব স্বাভাবিক হয় না। একটি দেশে ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের সুপারিশ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

ল্যানসেট-এর প্রথম প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারতে সন্তান প্রসবে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার বাড়ছে। সরকারি পরিসংখ্যানে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে বছরে ৩ লাখের বেশি শিশুর জন্ম হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে।

২০০৪ সালের জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হতো অস্ত্রোপচারে। ২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। এরপর ২০১১ সালের জরিপে দেখা যায় যে পরিস্থিতি গুরুতর হচ্ছে। ১৭ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। প্রয়োজন না থাকলেও ২ শতাংশ অস্ত্রোপচার অতিরিক্ত করা হয়।

কিন্তু সরকারি তরফে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় এটা বাড়তেই থাকে। ২০১৪ সালের জরিপে দেখা যায়, দেশে ২৩ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। অর্থাৎ, ৮ শতাংশ সন্তানের জন্ম হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে। জরিপটি ছিল তিন বছর আগের। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

সেভ দ্য চিলড্রেনের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক মান্নান দেড় দশকের বেশি সময় ধরে নিরাপদ মাতৃত্ব ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বছরে ৮ লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৩০ হাজার শিশুর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের দরকার ছিল না। বছরে ৩৪ লাখ ৭৮ হাজারের মতো শিশুর জন্ম হয় বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।

ইশতিয়াক মান্নান বলেন, স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস হয় না বলে এই অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হচ্ছে। স্বাভাবিক প্রসবে কিছু বিলম্ব হয়। অনেক চিকিৎসক বিলম্ব করতে রাজি থাকেন না। দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে অস্ত্রোপচারের প্রসবে ফি অনেক বেশি। চিকিৎসক যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেই প্রতিষ্ঠানেরও চাপ থাকে স্বাভাবিক প্রসব না করানোর জন্য। এ ছাড়া শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীদের একটি অংশ অস্ত্রোপচারকেই বেছে নিচ্ছেন।

অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়মিত বুলেটিনে আটটি দেশের দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের বছরে পাঁচ কোর্স (এক কোর্স এক, দুই, তিন, পাঁচ বা সাত দিনের হতে পারে) অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়।

ওই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) গবেষক মুস্তাফা মাহফুজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০ শিশুকে আমরা জন্মের পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছি। মা, পরিবারের অন্য সদস্য ও চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র থেকে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের তথ্য সংগ্রহ করি।’

গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স শেষ হয় না, আবার কে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শ দেন, তা সঠিকভাবে জানা যায় না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের জন্য বছরে পাঁচ কোর্স অ্যান্টিব্যায়োটিক অসম্ভব পরিমাণে বেশি। শিশুরা সাধারণত ভাইরাসজনিত রোগে বেশি ভোগে। আর অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় ব্যাকটেরিয়া দমনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে। এই ওষুধ বিশেষজ্ঞ বলেন, বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, পরিণত বয়সে দীর্ঘমেয়াদি রোগ বা ক্রনিক ডিজিজে ভোগার সঙ্গে শিশু বয়সে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের সম্পর্ক আছে। শিশু বয়সে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে তা পরিণত বয়সে অ্যালার্জি ও রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতার ওপর প্রভাব ফেলে।

শুধু শিশুদের ক্ষেত্রে নয়, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার সব বয়সী মানুষের ক্ষেত্রে হচ্ছে। বিএসএমএমইউ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধবিজ্ঞান বিভাগের একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, অতি ব্যবহার বা অযৌক্তিক ব্যবহারের কারণে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে।

ল্যানসেটে কী আছে

ল্যানসেট বলেছে, ওষুধের অতি ব্যবহার দুনিয়াজুড়ে বাড়ছে, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। এই ১০ বছরে ব্রাজিল, চীন, ভারত, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় বেড়েছে ৭৬ শতাংশ। হাঁটু প্রতিস্থাপন অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪ শতাংশ অস্ত্রোপচার অপ্রয়োজনীয়। স্পেনে এই হার ২৬ শতাংশ।

ক্যানসার শনাক্ত পরীক্ষার অতি ব্যবহার হচ্ছে বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রবন্ধে দাবি করা হয়েছে, দুনিয়াব্যাপী হৃদ্‌রোগ চিকিৎসার নানা পদ্ধতির অতি ব্যবহার হচ্ছে। প্রয়োজন না থাকলেও রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রবণতা বহু দেশে দেখা যাচ্ছে।

ক্ষতি ও করণীয়

ল্যানসেট বলেছে, ওষুধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা অন্য সেবার অতি ব্যবহারের কারণে রোগী শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বছরে প্রায় ১৪ হাজার মানুষের অপ্রয়োজনীয় হাঁটু প্রতিস্থাপন ও ঊরু অস্থিতে অস্ত্রোপচার হয়। এটা সরাসরি তাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের প্রধান সৈয়দ শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি রোগের চিকিৎসা বা রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা বা হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে নির্দেশিকা বা গাইডলাইন থাকা দরকার। নির্দেশিকা অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তা নজরদারির ব্যবস্থাও থাকা দরকার।

ল্যানসেট বলেছে, এ বিষয়ে প্রমাণ তৈরির জন্য গবেষণা করা দরকার। পাশাপাশি চিকিৎসক, রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারকদের সমস্যাটি অনুধাবন করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।