বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার সঙ্গে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) প্রেসিডেন্ট ও সিইও লরেঞ্জো তান জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন ব্যাংকটির মাকাতি শহরের জুপিটার স্ট্রিট শাখার ব্যবস্থাপক মাইয়া সানতোস দেগুইতো। তিনি বলেছেন, ব্যাংকটির প্রেসিডেন্ট অর্থ স্থানান্তরের ওই অবৈধ প্রক্রিয়ার কথা আগে থেকেই জানতেন এবং বাংলাদেশের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে তাঁর বন্ধু জড়িত ছিলেন।
গতকাল সোমবার ফিলিপাইনের সংবাদমাধ্যম এবিএস-সিবিএন নিউজকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে দেগুইতো বলেন, তান হচ্ছেন কিম ওংয়ের বন্ধু, যিনি ওই ছয় ব্যাংক হিসাবের একটির মালিক এবং ওই ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা অবৈধভাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে প্যারানকুয়ে সিটির ক্যাসিনোতে নিয়ে ওই অর্থ বৈধ করে অন্য দেশে পাচার করে দেওয়া হয়।
দেগুইতো বলেন, ‘কিম ওং চার ব্যক্তিকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তাঁরা গত বছরের (২০১৫) মে মাসে আমাদের ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলেন। ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোই জালিয়াতির কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ওই ব্যক্তিরা হলেন মিকায়েল ফ্র্যানসিসকো ক্রুজ, জেসি ক্রিসটোফার লাগ্রোসাস, আলফ্রেড সানতোস ভেরগারা ও এনরিকো তিওদোরো ভাসকুয়েজ।’ তিনি বলেন, ‘ওই ছয় জনেরসঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল সোলেয়ার হোটেলে। যা আমি এর আগে একটি রেডিওতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছি।’
কেন তিনি ওই লোকগুলোর সঙ্গে একটি হোটেলে গিয়ে দেখা করতে রাজি হলেন-এ প্রশ্নের জবাবে দেগুইতো বলেন, ‘কিম ওং আমাদের ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের (লরেঞ্জো তান) ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং এ কারণেই হয়তো তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনার সুযোগ রাখা হয়।’
দেগুইতো বলেন, ওং গত ৫ ফেব্রুয়ারি আদেশ দিয়েছিলেন সেখানকার স্থানীয় গার্মেন্ট ব্যবসায়ী উইলিয়াম গোর নামে একটি ডলার অ্যাকাউন্ট খুলতে এবং ওই দিনই আট কোটি ১০ লাখ ডলার তাঁদের ব্যাংকে জমা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ম্যানেজার অবশ্য স্বীকার করেছেন যে ওংয়ের ওই আদেশ উইলিয়াম গো জানতেন কি না তা সত্যায়িত করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এদিকে উইলিয়াম গো তাঁর আইন পরামর্শক র্যামন এসগুয়েরার মাধ্যমে জানান যে তিনি ওই ডলার অ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়ে কিছুই জানতেন না এবং দেগুইতো তাঁর স্বাক্ষর জাল করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
কিন্তু দেগুইতে সেটা অস্বীকার করে বলেছেন, অ্যাকাউন্ট খোলার কাগজপত্রে গোর স্বাক্ষর এনে দিয়েছিলেন ওং এবং ব্যাংকে খোলা তাঁর পেসো অ্যাকাউন্টের সঙ্গে ওই স্বাক্ষর হুবহু মিলে যায়।
আরসিবিসি ওই জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত শুরুর পর ওই প্রশ্নবিদ্ধ ব্যাংক হিসাব বন্ধ করার জন্য ব্যাংক ম্যানেজার গোকে এক কোটি পেসো ঘুষ দিতে চেয়েছেন বলে গো যে দাবি করেছেন তা মিথ্যা বলে ঘোষণা দেন দেগুইতো।
দেগুইতো আরো বলেন, অর্থ স্থানান্তরের ওই অবৈধ তারবার্তা প্রথমে আসে আরসিবিসির প্রধান কার্যালয়ে, এরপর সেটা ব্যাংকের জুপিটার শাখায় আসে। তিনি বলেন, হঠাৎ এত বড় অঙ্কের অর্থ জমা করার বিষয়টি নিয়ে প্রধান কার্যালয়ের কাছে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন; কিন্তু আরসিবিসির সেটেলমেন্ট ডিভিশন এর পরও ওই স্থানান্তর আটকে দিতে ‘লাল পতাকা’ তোলেনি। তিনি বলেন, গোর অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার আগে ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগ ওই ডলার পেসোতে রূপান্তর পর্যন্ত করে দেয়। তিনি দাবি করেন, ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তান ওই স্থানান্তর সম্পর্কে সব কিছুই জানতেন।
দেগুইতো বলছেন, এত বড় অঙ্ক স্থানান্তরের আগে আরসিবিসি ট্রেজারির ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। তা ছাড়া আপাতদৃষ্টিতে এই জালিয়াতির মূল হোতা হিসেবে তাঁকে (দেগুইতোকে) জড়ানোর জন্য বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি।
দেগুইতোর এ দাবির বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন তানের আইনজীবী অ্যাটর্নি ফ্রান্সিস লিম।
এদিকে ফিলিপাইনের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ ওই ব্যাংক চুরির ঘটনা তদন্তের মধ্যে দেগুইতো গত শুক্রবার স্বামী-সন্তানকে নিয়ে জাপান চলে যেতে চেয়েছিলেন। ম্যানিলা বিমানবন্দরে তাঁকে আটকে দেয় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনার পর দেগুইতোর নিয়োগ করা পরামর্শক ফার্ডিনান্দ তোপাসিও বলেন, ভ্রমণের অধিকার ভঙ্গের দায়ে তাঁর মক্কেল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার বিষয়টি বিবেচনা করছেন। তিনি বলেন, তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি এবং তিনি কর্তৃপক্ষকে এটা তো নিশ্চিত করেছিলেন যে জাপানে ছোট্ট একটি পারিবারিক ছুটি কাটিয়ে সপ্তাহান্তের পর তিনি সিনেট শুনানির আগেই ফিরে আসতেন।
এরই মধ্যে আরসিবিসির গ্রাহক উইলিয়াম গো ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনকে চিঠি দিয়েছেন এবং তাতে তিনি দাবি করেন, ওই দুটি বিদেশি মুদ্রা অ্যাকাউন্ট (একটি তাঁর নিজের নামে এবং অন্যটি তাঁর গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান সেঞ্চুরি টেক্সের নামে) তিনি খোলেননি।
গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে গোর আইনজীবী র্যামন এসগুয়েরা বলেন, দেগুইতো তাঁর মক্কেলকে ওই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে স্থানান্তরের বিষয়টি চাপা দেওয়ার জন্য একটি বড় অঙ্কের অর্থ (দুই কোটি পেসো পর্যন্ত) ঘুষ সেধেছিলেন।