ঢাকা, মে ২, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১৩:০৯:২৫

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

পূর্ব লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল জিম্মি চুক্তিতে হামাসকে রাজি করাতে মিসর ও কাতারের দ্বারস্থ বাইডেন দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক মহড়া চীনের গাজা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে রমজানে মুসলমানদের আল আকসায় নামাজ পড়ার অনুমতি দিতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ গাজায় তুমুল যুদ্ধ ॥ চলছে যুদ্ধবিরতির বৈঠক জর্ডানে মার্কিন সৈন্য হত্যা ॥ দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার অঙ্গীকার যুক্তরাষ্ট্রের গাজা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে জাতিসংঘ দূতদের সাক্ষাত জি৭ নেতাদের ভিডিও শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী না হলে বাইডেন ও অনিশ্চিত

কারবালার যুদ্ধে সহযোগীতা করেছিলেন ব্রাহ্মণেরাও!

| ১২ কার্তিক ১৪২২ | Tuesday, October 27, 2015

কারবালার যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ব্রাহ্মণেরাও!

ব্রিটিশ শাসনামলে সামরিক গোত্র বলে চিহ্নিত হয় দত্ত গোষ্ঠীর একটি অংশ, যারা পরিচিত হুসাইনি ব্রাহ্মণ নামে। পুনে’র এখনকার হুসাইনি বাহ্মণদের মতে, তাদের পূর্বপুরুষেরা ইমাম হুসাইনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কারবালা যুদ্ধে অংশ নেয়। ওই ঘটনা স্মরণ করে তাদের গোত্র এখনো মুহাররম পালন করে।

তাদের মতে, এখন প্রায় ৫শ জনের এই গোত্র নিজেরাই নিজেদের নাম হুসাইনি ব্রাহ্মণ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা জানায়, তাদের পূর্বপুরুষ রাহিব দত্ত আরবে গিয়ে তার বন্ধু ইমাম হুসাইনকে সাহায্য করেন। তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে নিজের সন্তানদেরকে নিয়ে যুদ্ধ করে এবং সে যুদ্ধে তার সন্তানেরা শহীদও হন। ইমাম হুসাইন তার এই ত্যাগ দেখে তাকে সুলতান উপাধি দেন এবং ভারতে ফিরে যেতে বলেন। ভারতে ফিরে রাহাব দত্ত তার অনুসারীদের হুসাইনি ব্রাহ্মণ নামকরণ করেন।

পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় অনেক মহিয়াল ব্রাহ্মণ বাস করে। তবে একমাত্র ‘দত্ত’ বংশদেরকেই যোদ্ধা বলা হয়। বেশিরভাগ দত্তই হিন্দু ধর্মালম্বী হলেও কেউ কেউ অন্য ধর্মও পালন করে থাকে। মহিয়ালের ৭টি গোত্রের মধ্যে একটি হচ্ছে দত্ত। হুসাইনি ব্রাহ্মণদেরকে মহিয়ালও বলা হয়ে থাকে। ইতিহাস মতে, শত শত বছর আগে তারা অনেক দূর থেকে পাঞ্জাবে যায়। তখন থেকেই তারা যোদ্ধা। অনেকে তো এখনও সেই পরম্পরা মেনে সেনাবাহিনীতে যোগদান করছেন।

এই গোত্রেরই কর্নেল (অব.) রামসারুপ বকশী বলেন, নিজেকে হুসাইনি ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় সবাই অবাক হয়। তিনি বলেন, ‘আমি যেই ফ্যাক্টরি চালাই, আমাদের গোত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার পর তারা খুবই অবাক হয় এবং চলে যায়।’ তবু ইমাম হুসাইনের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকতে পেরে গর্ববোধ করেন বলেই জানান তিনি। তার মতে, এটি খুবই গর্বের বিষয় এবং এরজন্য হিন্দু ‍ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ জোরদার হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা হিন্দু-মুসলিমের মাঝে শতবর্ষ পুরোনো বন্ধুত্বের স্বাক্ষর বহন করি।’

বিশিষ্ট আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী নেত্রপ্রকাশ ভোগও একজন হুসাইনি ব্রাহ্মণ। তিনিও তার এই গোত্রের জন্য খুবই গর্বিত বলে জানান, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা ন্যায়বিচারের জন্য ইমাম হুসাইনের পক্ষে লড়েছেন। আমরা এখনও অন্তরে সেই ত্যাগকে লালন করি।’ পুনের মহিয়াল সমাজের প্রেসিডেন্ট জিতেন্দ্র মোহন বলেন, ‘আমরা আমাদের সামরিক রীতি চালু রেখেছি। আমরা প্রতিনিয়তই সেনাবাহিনীতে যোগদান করছি।’


কারবালার যুদ্ধ
৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মহররম কারবালার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সে যুদ্ধেই শহীদ হন মোহাম্মদ (স.) এর দৌহিত্র হুসাইন ইবন আলি। যুদ্ধে উম্মাদ খলিফা ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তিনি। ১০ই মুহাররমের দিনটিকে এখনো বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহরা পালন করে থাকে।

ইমাম হুসাইন ও রাহিব দত্ত 
ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী, কারবালার যুদ্ধে একটা সময় কোণঠাসা হয়ে পড়েন ইমাম হুসাইন। তার মা ফাতিমা এবং বাবা আলি তখন অত্যাচারী রাজা ইয়াজিদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে আসেন। কিন্তু যুদ্ধে খাবার ও পানির অভাবে পড়ে হুসাইনের বাহিনী। চারদিকে শত্রুপক্ষ ঘিরে ফেললে একদমই কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা।

এসময় যুদ্ধে এগিয়ে আসেন হিন্দু ব্রাহ্মণ রাহিব সিধ দত্ত। আরবে তিনি অত্যন্ত সম্মানীয় একজন ব্যক্তিত্ব এবং ইমাম হুসাইনের ভালো বন্ধু। কারাবালার যুদ্ধে তিনিও তার সাত সন্তানকে হারান। তারা হলো, ও পোরে, রাম সিং, হারাস রায়, রাই পুন, সাহস রায়, শের খান এবং ধারু। ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলি ইবন আবু তালিবের বড় ছেলে ইমাম হাসান নিহত হওয়ার কিছুদিন পরে আলিকেও হত্যা করা হয়। এরপর ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অবতীর্ণ হন আলির ছোট ছেলে ইমাম হুসাইন।

কিন্তু সেসময় মাত্র ২০০ জন সেনা নিয়েই যুদ্ধে নামতে হয় তাকে যার মাঝে ৭২ জনেই ছিলো তার পরিবারের সদস্য। তখন রাহিব সিধ দত্ত এসে ইমাম হুসাইনের পাশে দাঁড়ান। মহররমের ৭ম দিনে ইয়াজিদের ৩০ হাজার সেনা হুসাইনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নদীর পারে ৬ হাজার সেনা পাহারা দেয় যেন হুসাইনের সঙ্গে থাকা নিষ্পাপদের মাঝে কোনো পানি পৌঁছাতে না পারে। ১০ মহররমের সন্ধ্যায় ইমাম হুসাইনের ছেলে ২২ বছর বয়সী আলি আকবর, তার সৎ ভাই আব্বাস, ৪ বছর বয়সী মেয়ে সখিনা ও ছয়মাসের শিশু আলি আসগরকে হত্যা করে ইয়াজিদি বাহিনী। এসময় ইমাম হুসাইনকেও মরুভূমিতে জবাই করা হয়।

ইমাম হুসাইনের শিরোশ্ছেদ করার সময় তাদের ধাওয়া করেন রাহিব দত্ত। এরপর তার মস্তক পুনরুদ্ধার করে দামাস্কাসে নিয়ে আসেন। ইতিহাস মতে, ইয়াজিদির সেনারা রাতে রাহিবকে আক্রমণ করে এবং হুসাইনের কাটা মাথা দাবি করে। তখন রাহিব নিজেই তার এক সন্তানের মাথা কেটে তাদের দেন। কিন্তু ইয়াজিদি সৈন্যরা চিৎকার করে বলে ওঠে এটা হুসাইনের মাথা না। এরপর আরেক সন্তানের মাথা কেটে ফেলেন। এভাবে এক এক করে সাত ছেলেরই শিরোশ্ছেদ করেন রাহিব। এর একবছর পরে তিনি ইমাম হুসাইনের কাটা মাথা দামাস্কাসে নিয়ে তার শরীরের সঙ্গে কবর দেন।

দত্ত গোত্র ও অন্যান্য মুসলিমরা ইয়াজিদের শাসনের ৪০ দিনের মাথায় তাকে উৎখাত করে। তখন ইমাম হুসাইনের সেনাপতি আমির মুখতারের সঙ্গে ইয়াজিদের গভর্নর ওবায়দুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যায় দত্ত। এরপর তাকে উৎখাত করে আনন্দ মিছিল করে তারা। ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করতে থাকে যে তারা ইমাম হুসাইনের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে। তবে কারবালার যুদ্ধের আগে থেকেই দত্তদের সঙ্গে সখ্যতা ছিলো মুসলিমদের। হযরত আলী একবার তাদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দত্ত সেনাদের সাহায্য করে।

এরপর দত্তদের উপর শিয়া সম্প্রদায় ও সুন্নি সম্প্রদায় হামলা করলে রহিব ইরান এবং তুর্কিস্থান হয়ে আফগানিস্তানে চলে যায়। ৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে তারা ভারতে ফিরে আসে এবং দিনা নগর (বর্তমান গুজরাটে) বসবাস শুরু করে। ভারতে ফিরে আসার পর স্থানীয় মহিয়ালদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান রহিব দত্ত ও তার অনুসারীরা।

এরপর রহিবের অনুসারীরা অনেক গোত্রে ভাগ হয়ে পড়েন। তবে বর্তমানে একমাত্র হুসাইনি ব্রাহ্মণই রহিব দত্তকে তাদের প্রকৃত পূর্বসুরী ভাবেন এবং মহররম পালন করেন। পরবর্তীতেও মুসলিমদের সঙ্গে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা রয়েছে দত্তদের। বেশকিছু ঘটনার মাধ্যমে কারবালার যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

যেমনটা ঘটেছিলো পীর ওয়াহুন এবং শিব দত্তের মাঝে। পীর ওয়াহুন অত্যন্ত জ্ঞানী একজন ব্যক্তি ছিলেন এবং খুব ভালো দাবা খেলতেন। তিনি তার সঙ্গে খেলায় হেরে যাওয়া ব্যক্তিকে দুটো শর্ত জুড়ে দিতেন। হয় তাকে প্রাণ দিতে হবে নয়তো ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। সবসময়ই তিনি খেলায় জিতে যেতেন।
কিন্তু একবার শিব দত্তের সঙ্গে টানা তিনটি ম্যাচ হেরে বসেন তিনি। তখন তিনি পীরের স্ত্রী এবং দুই সন্তানের জীবন চান। এতে বিপাকে পড়ে যান পীর। তবে শিব দত্ত অবশ্য এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেননি। তিনি তাদের মাফ করে দেন।

এরপর তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে ওয়াহুন জানতে পারেন শিব দত্তের পূর্বসূরী রহিব দত্ত ইমাম হুসাইনের জন্য তার ৭ সন্তানকে কুরবানী করেন। এরপর পীর ওয়াহুন শপথ করেন যে তিনি আর কোনো হিন্দুকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলবেন না। তার একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, ‘ওয়াহ দত্ত সুলতান, হিন্দু ধর্ম মুসালমান কা ইমান, আধা হিন্দু-আধা মুসালমান (বাহ! সুলতান, তুমি তো হিন্দু হলেও মুসলিমদের বিশ্বাস। তুমি অর্ধেক হিন্দু, অর্ধেক মুসলমান।’

আরেকটি ঘটনায় জানা যায়,ইমাম হুসাইনের স্ত্রী শাহর বানু আসলে চন্দ্রলেখা বা মেহর বানুর বোন ছিলেন। মেহের বানু আবার ভারতীয় রাজা চন্দ্রগুপ্তার স্ত্রী ছিলেন। ইমাম হুসাইন যখন জানতে পারেন যে ইয়াজিদ তাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছেন তখন ভারতীয় এই রাজার সাহায্য চেয়ে একটি চিঠি লেখেন তিনি। চিঠি পেয়ে ইরাকে একটি বড় সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন চন্দ্রগুপ্তা। তবে সেই সেনাবাহিনী পৌছানোর আগেই ইমাম হুসাইনকে হত্যা করা হয়।

তারা কুফা শহরে পৌছানোর পর (বর্তমান ইরাক) ইমাম হুসাইনের প্রতিনিধি মুখতার সাকাফি তাদের অভ্যর্থনা জানান। তিনি ভারতীয় এই সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ এক স্থানে থাকার ব্যবস্থা করেন। এখনও সেই স্থানটি ‘দায়ের-ই-হিন্দিয়া’ নামে পরিচিত। যার অর্থ ভারতীয় কলোনি। দত্ত ব্রাহ্মণদের কিছু যোদ্ধা ভুরইয়া দত্তের নেতৃত্বে মুখতার সাকফির সঙ্গে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তারাই শুধু কুফায় থাকেন এবং বাকিরা ভারতে ফিরে যান। সেখানে তারা হুসাইনি ব্রাহ্মণ নামে নতুন এক সম্প্রদায় তৈরি করেন।

এছাড়া হুসাইনি ব্রাহ্মণদের নিয়ে আরো কয়েকটি ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। আহমেদ পাঞ্জাবীর লেখা জিং নামা বইটির ১৭৫-১৭৬ নাম্মার পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে  শিয়ারা তাদের প্রতিদিনের নামাজে রাহাব দত্তের কথা উল্লেখ করেন। কারবালার ঘটনার সময় ১৪০০ হুসাইনি ব্রাহ্মণ বাগদাদে বাস করতো। এছাড়া ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘কারবালা’ বইটিতেও দত্তদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুন্সি প্রেম চান্দ বলেন, কারবালায় যে হিন্দুরা মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলো তারা আশভাতামার উত্তরসূরী। এতে করে হুসাইনি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরো স্পষ্ট হয়। কারণ দত্তরা আশভাতমাকে তাদের পূর্বসুরী বলে দাবি করে।

রাহাবের একজন পূর্বসূরী সিধ বিয়োগ দত্ত আরবে তার বসতি গড়েন। এবং তিনি সুলতান উপাধিও পান। তিনি খুবই দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন এবং মির সিদানী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ব্রহ্মার পুজা করতেন এবং সিধ জোজা’র ছেলে ছিলেন।

সূত্র: হিন্দু ডট বিজি