ঢাকা, মে ২, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১৯:২৭:০২

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

পূর্ব লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল জিম্মি চুক্তিতে হামাসকে রাজি করাতে মিসর ও কাতারের দ্বারস্থ বাইডেন দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক মহড়া চীনের গাজা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে রমজানে মুসলমানদের আল আকসায় নামাজ পড়ার অনুমতি দিতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ গাজায় তুমুল যুদ্ধ ॥ চলছে যুদ্ধবিরতির বৈঠক জর্ডানে মার্কিন সৈন্য হত্যা ॥ দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার অঙ্গীকার যুক্তরাষ্ট্রের গাজা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে জাতিসংঘ দূতদের সাক্ষাত জি৭ নেতাদের ভিডিও শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী না হলে বাইডেন ও অনিশ্চিত

আরব আমিরাতে শারদ উৎসব

| ১১ কার্তিক ১৪২২ | Monday, October 26, 2015

আবুধাবির পূজামণ্ডপ

সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি, দুবাই ও আলআইকে শারদীয় উৎসব উদ্‌যাপিত হলো। দেবী দুর্গার পূজায় গিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তারা ধর্মীয় বিষয়টির পাশাপাশি সামাজিক দিকটিরও গুরুত্ব দিতে পেরেছেন। ঢাক, কাঁসরের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনি তাদের মনে পবিত্রতা এনেছে। তারা পুণ্য আহরণ করেছেন। তাদের বিশ্বাস—দেবী দুর্গার আবির্ভাবে পৃথিবী থেকে আসুরিক শক্তির পতন হবে।
বঙ্গীয় হিন্দু ধর্মানুরাগীরা রাজধানী আবুধাবির ফুডল্যান্ডে পূজার আয়োজন করেন। এপার বাংলার দর্শকেরাও সেখানে শামিল হয়েছেন। উপভোগ করেছেন শারদীয় উৎসব। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত টানা পাঁচ দিনই ভবনের প্রশস্ত দোতলার কনফারেন্স হল ছিল লোকে লোকারণ্য। সরগরম ছিল প্রতিটি পর্ব।
দেয়াল কর্ম ছিল এখানকার আলাদা এক আকর্ষণ। দুটি অংশ নিয়ে এ পৃথিবী। একদিকে ছিল দীর্ঘ জমিনের দেয়ালিকা। অন্যদিকে চারু ও কারুকাজের উপস্থাপনা। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে অখণ্ড এ উদ্যোগ পূজা আয়োজনকে আলাদা এক উচ্চতায় নিয়ে যায়।
দেবী মহামায়া মর্ত্য থেকে কৈলাসে চলে গিয়েছেন। এবার তিনি এসেছেন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে। আর বিদায় নিয়েছেন দোলায় চড়ে। বিদায় লগ্নে সিঁদুর পরানো পর্বটি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। সিঁদুর মঙ্গলের প্রতীক। এর মধ্য দিয়ে এক নারী আর এক নারীকে আশীর্বাদে-ভালোবাসায় শুভেচ্ছায় সিক্ত করেন।

দুবাইয়ে সিঁদুর খেলা

আবহমান বাংলার পুণ্যার্থীরা দেবী দুর্গার একটি রূপ মনে মনে নির্মাণ করে নিয়েছেন। দেবী তাদের কাছে নারীর মতো শাশ্বত এক চরিত্র। মিহি সুতার বুননে লাল পেড়ে সোনালি বর্ণের শাড়ি সজ্জিতা জননী। সঙ্গে তার দুই পুত্র গণদেবতা গণেশ, সুদর্শন সশস্ত্র কার্তিক আর দুই কন্যা-ধনে পরবিনী লক্ষ্মী ও বিদ্যাদেবী শুভ্র সমুজ্জ্বলা সরস্বতী। আছে ইঁদুর, ময়ূর, প্যাঁচা, হাঁস। দুর্গার চোখ বিস্ফোরিত দীপ্তোজ্জ্বল। হাতে ত্রিশূল, সিংহ তার বাহন। মহিষাসুরকে করা হয়েছে এ ফোঁড়-ওফোঁড়।
হিমালয় কন্যা দুর্গা এসেছেন মর্ত্যে। মা মেনকা বাপের বাড়িতে কন্যার সব ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন। এখানে ধূপ-দীপ সাজানো আছে। পুরোহিতের মন্ত্র, ঘণ্টা ও শঙ্খধ্বনি মুখরিত করে চরাচর। আরতিতে তরুণ-তরুণীর অংশগ্রহণ আলাদা সৌন্দর্য আনে। ঢাকের বাদ্য, ঢাক-কাঁসরের শব্দ মোহনীয় এক পরিবেশের সৃষ্টি করে।
তরুণীরা পূজামণ্ডপে এসেছে শাড়ি পরে। কেউবা এই প্রথম এই পরিচ্ছদে। একইভাবে তরুণী মায়েদের মধ্যে ভিন্ন স্বাদের এক অনুভূতি। মন্দিরে গিয়েছেন ফুল, ফল-ফলারি, মিষ্টির নৈবেদ্য সাজিয়ে মায়ের পাদপদ্মে অর্ঘ্য দিতে। ছোটরা কেউ বা শাড়ি-ব্লাউজ বা পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়েছে। কেউ বা আবার ধুতি পরেছে।
প্রকৌশলী বিজয় কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, দুবাইতে বঙ্গীয় বাঙালিরা পূজার আয়োজন করেন। ব্যাপক দর্শকের সমাগম ঘটে সেখানে। এপার বাংলার হিন্দু ধর্মীয় সদস্যরাও হোটেল বা অনুরূপ প্রশস্ত জায়গায় দুর্গা মায়ের অর্চনা করেন। এক পূজায় যুক্ত ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্থপতি মঞ্জুলা দেব। অন্য আয়োজনে ব্রততী সরকার, মিতা সাহা, ইতি রায় চৌধুরী, চৈতি তালুকদার ও মিতা সাহার উজ্জ্বল অংশগ্রহণ ছিল। আল আইনেও এপার বাংলার পূজার্থীরা আয়োজন অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। সংগীতে, নৃত্যে তারা দেশ মায়ের প্রতিও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন।
আবুধাবির দেয়াল চিত্রে আয়োজকেরা বালুচরি শাড়ি এঁকেছেন। মুর্শিদাবাদের বিষ্ণুপুরের বালুচর গ্রাম থেকে এই শাড়ির নাম। নারীদের বালুচরি ভালোবাসা অনেক বছর আগেকার। এখনো সেই অনুভূতি প্রতিটি নারীর হৃদয়ে।
শিল্পীদের সঙ্গে এপার বাংলার নারীরা

নির্মীয়মাণ একটি নৌকার ছবি দর্শককে টানে। অবিভক্ত বাংলার হুগলির বলাগড় ছিল নৌকা, স্টিমার তৈরির অন্যতম কেন্দ্র। এখানকার নৌকা যেত বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ওডিশা। আসত সেগুলো যশোর, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবনাসহ অন্তত ২০টি জেলায়। সেসব নৌকার চিত্ররূপ দেখানো হয়েছে দেয়ালের গায়ে।
বিশাল কলামে সেঁটে দেওয়া একটি নৌকা—সেটা কাঠের পাতলা ফালি দিয়ে বানানো হয়েছে। কারুকলার এ কর্মটি যন্ত্র প্রকৌশলী বিদিশার কৃতিত্ব। নৌকার পেছনে বিশাল এক নদী। সেখানে দূরে ভাসছে ছোট সে ডিঙি। মাঝি সামলাচ্ছেন। ডাঙার পাশেই বাঁশঝাড়। রং ও দক্ষতার ফসলের ছাপ। মনে হচ্ছে একেবারেই কাচা। শিল্পকর্মটি দেখার সময় কথা হয় শিল্পীর জননীর সঙ্গে। তিনি নীতা ঘোষ। তারও আরেক বিলুপ্তি কর্ম ঝুলছে পাশের কলামে। কাদা মাটির মণ্ড থেকে বিশেষ আকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেটা কাগজের ওপর রেখে কালো রঙের প্রলেপ দেওয়া। তারপর ধাতব রং ছড়ানো। এটা ভোকরা মেটাল আর্ট। তিনি এনেছেন মানব-মানবীর মূর্ত প্রতীক। তারা খোল করতাল বাজাচ্ছেন-আনন্দ করছেন-সৃষ্টির মহিমা প্রকাশ করছেন। নীতা ঘোষ গভীর মমতায় তার শিল্পের ব্যাখ্যা দেন।
মৌসুমি মুখার্জি একজন সমাজ সংগঠক। নিবেদিত স্থাপত্যে ও চারু কারুকলায়। তিনি এবার প্রদর্শন করেন নকশিকাঁথা। এর প্রতিটি ফোড়ের সঙ্গে থাকে এক নারীর সুখ-দুঃখ তার আশা-আকাঙ্ক্ষার মিশ্রণ। নারীর জীবন যাপনের বৈচিত্র্য ফুটে ওঠে এর মধ্য দিয়ে। দর্শকও খুঁজে ফেরেন আরও আরও কিছু।
মৌসুমি ছোটদের কাজগুলো দেখালেন। দারুণ মেধার সাক্ষর। পটচিত্র, মুখোশ ইত্যাদি নির্মাণে মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছে তারা। ঐশ্বরিয়া, অর্পণ দীপা, তানিয়া—ওদের কারও সঙ্গে দেখা হয় না স্কুল খোলা থাকার কারণে। শর্মিষ্ঠা ভট্টাচার্য ধরেছেন বাটিক। কাপড়ের ওপরকার হাতি তখন শুঁড় তুলছে।
নিজের শিল্পকর্মের সামনে শিল্পী নীতা ঘোষ

অবন্তি সেনগুপ্ত বাঁশ-বেত ব্যবহার করেছেন তার কাজে। ধামা, ঝুড়ি ইত্যাদি সামগ্রী গড়ার মধ্য দিয়ে তিনি সার্থক শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন। প্রদর্শনীতে তার এই কর্ম বলতে চায়—অবন্তি শুধু অভিনয়ে সফল নন শিল্প বা কারুকর্মেও।
দেয়াল কর্মের এ আয়োজনটি পরিকল্পনা করেছেন স্থপতি দেবাশীষ মান্না। তিনিই শিল্পীদের হাতে এক একটি কাজ ধরিয়ে দেন। উৎসাহী এ গোষ্ঠীটি তাদের সৃজনশীলতার সাক্ষর রাখেন কর্মের মধ্য দিয়ে।
বিস্তৃত ছাপা কাগজে প্রাণীর দাঁত-শিং কিংবা দেহ-অবয়ব থেকে তৈরি শাখা শঙ্খ আংটি ইত্যাদি উপকরণও আকর্ষণ করে দর্শককে। পোড়ামাটির টেরাকোটার ব্যবহার করা হয়েছে একটি নির্মাণে। চব্বিশ পরগনার পণ কুড়ার এ ভাবটি তখনো জ্বলজ্বল করছে।
মাটির পাত্রে পটুয়ার করা রং—সে এক আলাদা অধ্যায়। নারীরা এ জগতের শক্তিশালী শিল্পী। চামড়ার তৈরি বিভিন্ন জিনিস সবার নজর কেড়েছে। শান্তিনিকেতনে ব্যবহৃত উপকরণের ছবিও ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। স্বর্ণের বিভিন্ন গয়নার নামও মনকাড়া। মাথার মুকুট, বাহুর কাঁকন বলয়, হাতের শাখা মানুষের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মান নির্ণয়ে নতুন নিশানা দেয়। কৃষ্ণনগরের পুতুলও অন্য রকম আকর্ষণ কাড়তে পেরেছে দর্শকদের।
পুষ্প বেষ্টনীতে দেখা হয় আয়োজকদের অন্যতম সংগঠক সেন শর্মার সঙ্গে। অঞ্জলি দেওয়ার জন্য তিনি হাতে তুলে দেন পুষ্প। কাকলি সেন শর্মা দেখলাম ভীষণ ব্যস্ত। ধীরা মুখার্জি ও রুমকি দত্ত শুভেচ্ছা জানান। কৌশিক দত্ত ছবি উৎসবের আয়োজন করেছেন। বার্তা দিলেন রাজকাহিনি দেখানো হচ্ছে। ছবির গল্পের প্রেক্ষাপট ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে। জয়া আহসান আছেন কেন্দ্রীয় চরিত্রে। এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হলো এই প্রতিবেদককে।
দুবাইয়ে দেবী দুর্গার সামনে ভক্তরা

দেখা হয় পরান পালের সঙ্গে। উৎসবের প্রতিবেদন কোথায় জানতে চাইলেন তিনি। বললাম, আজই তো এলাম। মনে পড়ে গেল সেই পুরোনো গল্প। নাটক মঞ্চস্থ হয় না কোনো কারণে। কিন্তু আলোচনাসহ সে সম্পর্কে লেখা চলে যায় কাগজে। প্রতিবেদক ওই দিন না আসাতে আরেক নাটকের পটভূমি তৈরি হয়ে যায়। এমনটি তো হতে দেওয়া যায় না, আমার কথা। প্রকৌশলী সুজন পাল তখন পাশে ছিলেন।
লাকী হালদার দেবীকে নৈবেদ্য দিয়ে এলেন। মলি কুণ্ড, ইন্দিরা কলি, রিংকু আইচ এলেন অঞ্জলি প্রদানে। প্রার্থনা করলেন রূপং দেহি, যশং দেহি…। বিশাল এ বাহিনী ঐতিহ্য বিষয়ক প্রদর্শনীতে এল। তারা দেখলেন প্রতিটি শিল্পকর্ম। এক সময় সবাই জ্বলে উঠলেন। বন্দী হলেন ক্যামেরায়, বন্দী করলেন প্রতিবেদককেও।
এদিকে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে তাৎক্ষণিক দৃশ্য তুলে ধরার পরপরই সুহৃদদের মধ্যে ঝড় ওঠে। ড. রায়হান জামিল জিজ্ঞেস করেন, কোথায়! মোহাম্মদ খোরশেদ জানতে চান সরাসরি ফোনে, কয়দিন চলবে। আজিম ফজলুল কাদের বলেন, আজই আসছেন। অধ্যাপক এস এম আবু তাহের আক্ষেপ করেন নিমন্ত্রণ পাননি বলে। বিলায়েত হিরো কোন ভবনে, কয় তলায় জানতে চান। সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়।
পূজার পুরো সময়টাতেই ছিল অন্য রকম আমেজ। আলোর সজ্জায়, পুষ্পরাজির শোভায়, ধূপ ধুনোয়, আরতির তুমুল নৃত্য গানে, ঢোল বাদ্য ঘণ্টায় মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে অঙ্গন। পুরোহিতের চন্দন শোভিত মুখাবয়ব, মন্ত্র আর স্তোত্রের গম্ভীর ধ্বনি অপূর্ব করে তোলে পরিবেশ। দেবী বিদায় নেন। দুঃখের সুর বাজে প্রকৃতিতে-মনে। সিঁদুর রাঙানো মুহূর্তও ব্যঞ্জনা দেয় দেবীর কৈলাস যাত্রার আগে। সাংস্কৃতিক পর্বও বিশেষ কৃতিত্বের দাবি করে গোটা দিনগুলোতে।
আয়োজকেরা তৃপ্তি পান সব বাঙালির সাড়া পেয়ে। দর্শকেরা উপভোগ করেন প্রতিটি পর্বের প্রতিটি মুহূর্ত। তারপর একসময় ছুটে চলেন নিজ নিজ গৃহের দিকে।