সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ফিরিয়ে এনে করা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়কে সংবিধান পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আগামী রোববার-সোমবারের মধ্যে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে বলে তিনি জানান।
আজ (বৃহস্পতিবার) জাতীয় সংসদে ৩০০ বিধি এবং বিচারপতিদের বেতন-ভাতা বাড়ানো সম্পর্কিত বিলের ওপর বক্তৃতা দেয়ার সময় তিনি এসব কথা বলেন।
এর আগে আজ দুপুরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংবিধান পরিপন্থী বলে রায় দেয় হাইকোর্ট। এ রায় নিয়ে আজ সংসদ ছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত। পয়েন্ট অব অর্ডারে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এমপিরা হাইকোর্টের রায়ের তীব্র সমালোচনা করেন। তারা ৩০০ বিধিতে আইনমন্ত্রীর বক্তব্য দাবি করেন।
পরে ৩০০ বিধিতে দেয়া বক্তব্যে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। এখনো বিশ্বাস করি, বিচার বিভাগ স্বাধীন। সেই জন্য আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে আগামী রোববার-সোমবারের মধ্যে আপিল করব। আমরা আইনি পথেই যাব। আমরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করব না।’
হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের প্রসঙ্গ টেনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে সংবিধানের এই সংশোধনী এনেছি। কিন্তু তারা রায়ে বলে দিলেন এটা অবৈধ। এখনো আমি বলি, এটা মোটেও অবৈধ নয়। উনারা যেটা বলছেন, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।’
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যে সংশোধনী পাস করেছিলাম, সেটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য, বিচারপতিদের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার জন্য। ৯৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনীর আগে যেটা ছিল, তা হলো মার্শাল ল ফরমান দ্বারা তৈরি। আমরা সেটা পরিবর্তন করেছি।’
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের একপর্যায়ে জাতীয় পার্টির সদস্যরা তীব্র হইচই শুরু করলে আইনমন্ত্রী কিছুটা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘দিস ইজ নট দ্য লাস্ট ডিসিশন। স্বাভাবিকভাবে উনারা উত্তেজিত হচ্ছেন। আপিল করলে এ সিদ্ধান্ত থাকবে না।’
এ আগে, বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের জানান, ‘হাইকোর্টের দেয়া এ আদেশে রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ। এ আদেশের বিরুদ্ধে আমরা আদালতের কাছে সার্টিফিকেট (সরাসরি আপিল করার অনুমতি) প্রার্থনা করেছি। আপিল করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এটা সরাসরি আপিল বিভাগে আপিল হিসেবে গণ্য হবে। সেভাবেই শুনানি হবে। কিন্তু আমরা এই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত রাখার জন্য আগামী রোববার আপিল বিভাগের চেম্বার জজের কাছে আবেদন করব।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, তিনজন বিচারপতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে তারা ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন এবং বাতিল করেছেন। তারা যুক্তি দেখিয়েছেন, বিচারকদের যদি সংসদ সদস্যদের দ্বারা অপসারণের বিধান রাখা হয়, তাহলে সেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। যুক্তি হিসেবে তারা দেখিয়েছেন, যেহেতু সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বিধানমতে, রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কোনো আইনপ্রণেতা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, সেহেতু বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে যা হবে, সেটাই কার্যকর হবে। রায়ে কমনওয়েলথভুক্ত কতগুলো দেশের উদাহরণ তুলে ধরেছেন আদালত। যেখানে তারা বলতে চেয়েছেন, অধিকাংশ দেশে এ জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল থাকে। এই ট্রাইব্যুনালই বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি নিষ্পত্তি করে থাকেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য ছিল, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর দ্বারা মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয়েছে। মূল সংবিধানে ফিরে যাওয়ার অর্থই হলো, মূল সংবিধানকে কোনো আদালত কোনো রকম অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন না। আদালত শুধু পরে আনা সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু সে বিষয়টি বিবেচনায় আসেনি।’
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল সম্পর্কে আদালতের রায়ে কোনো পর্যবেক্ষণ এসেছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অন্যান্য দেশের বিচারকদের অপসারণের ব্যাপারে ট্রাইব্যুনাল বা আলাদা সংস্থা আছে। আদালত কোনো দিন সংবিধানের কোনো ধারা সংযোজন করা হোক বা কোনা ধারা বাদ দেওয়া হোক—এ কথা বলতে পারেন না। শুধু তারা যদি মনে করেন, কোনো বিধান বা কোনো অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তখন তা বাতিল বলে ঘোষণা দিতে পারেন। আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, সংসদের হাতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দুর্ঘটনামাত্র।
দুপুরে হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। এই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের রায়ে এ সংক্রান্ত আদেশ দেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে এই সংশোধনী বাতিল করা হয়। এর ফলে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আর জাতীয় সংসদের সদস্যদের হাতে থাকল না। #