সম্মেলনের আগে আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হবে। যেসব নেতার কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ বিতর্কিত হচ্ছে তাদের চিহ্নিত করতে এ অভিযান চলবে। দলটির শীর্ষনেতাদের দাবি বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা হাইব্রিড ও দলে অনুপ্রবেশকারী। তাদের সরিয়ে কিন ইমেজের নেতাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে। এটি করতেই দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঈদের পরে ও জাতীয় সম্মেলনের আগে শুদ্ধি অভিযান শুরু হবে। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের কয়েকজন নেতা আমাদের সময়কে শুদ্ধি অভিযানের তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ এ বিষয়ে আমাদের সময়কে বলেন, কিছু নেতার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। আমরা এসব নেতাকে চিহ্নিত করছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত ১৭ আগস্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মেজর জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলেছেন কুমিল্লা-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সুবিদ আলী ভূঁইয়া। তিনি ২০০১ সালে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে হেরে যান। পরে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনি এমপি নির্বাচিত হন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সুবিদ আলী আবার আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হন। বিষয়টি অস্বীকার করে সুবিদ আলী সংবাদ সম্মেলন করলেও আত্মপক্ষে জোরালো ভূ’মিকা পালন করতে পারেননি। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের প থেকে দাউদকান্দি উপজেলার যুবলীগ নেতা জিলানী সরকার ঢাকা মহানগর হাকিম সত্যপদ শিকদারের আদালতে মামলা করেন।
এর আগে চট্টগ্রাম-১০ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ কম্পিউটার প্রোগ্রামের ফটোশপের মাধ্যমে নিজের শরীরের অংশের সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মুখম-ল লাগিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেন। খোদ আওয়ামী লীগ থেকেই এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ ওঠে। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের প থেকে মানহানির মামলা করা হয়। আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধী, জামায়াত-শিবিরি বর্জন করলেও চট্টগ্রামের এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত চট্টগ্রামের মাওলানা সামসুদ্দিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অভিযোগ আছে।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদকে হত্যার অভিযোগে টাঙ্গাইল-৩ আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানাকে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি আওয়ামী লীগ।
শুধু তা-ই নয়, দলীয় কোন্দল সৃষ্টিকারী অনেক এমপির বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত লালনের অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এ রকম অনেক অভিযোগ আছে যেখানে দলের ত্যাগী নেতারা বঞ্চিত। অনেক এমপির বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষের লোকজন লালনের অভিযোগ আছে। অনেক স্থানে এসব অনুপ্রবেশকারীকে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। যেসব স্থানে এসব অনুপ্রবেশকারী ঢুকেছে সেখানেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই দল থেকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে কোনো সময় শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে অনুপ্রবেশকারীদের শনাক্ত করতে হবে।
দলে অনুপ্রবেশকারী ও হাইব্রিডদের নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, দলে হাইব্রিডে ভরে গেছে। ক্ষমতায় থাকার কারণে আগাছা-পরগাছায় ভরে গেছে। আওয়ামী লীগের এই শীর্ষ নেতা বলেন, দলে বসে মস্তানি-খুনোখুনি করা চলবে না। দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে শিগগিরই শুদ্ধি অভিযান চালানোর ইঙ্গিত দিয়ে দলের নেতা ও এমপি-মন্ত্রীদের কড়া সতর্ক করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী যেই হোক তাকে মা করা হবে না। অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না। অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যেই জড়িত হবে কোনোদিক না তাকিয়ে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ তাদের রা করতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, বিগত নির্বাচনগুলোয় প্রার্থী বাছাইয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের কঠোর নির্দেশনা অমান্যকারী নেতাদের জেলা, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। এ ছাড়া যেসব নেতার বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল ও সন্ত্রাসের প্রমাণ রয়েছে তারা বাদ পড়তে যাচ্ছেন দলীয় নেতৃত্ব থেকে। আওয়ামী লীগ অফিস সূত্রে জানা যায়, বিতর্কিত নেতাদের একটি তালিকা শেখ হাসিনার হাতে আছে। এ ছাড়া তিনি দলে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের তালিকাও চেয়েছেন। এ নিয়ে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানমন্ত্রীকে তথ্য দিচ্ছে।
জেলাওয়ারি খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সংসদ নির্বাচনের পর ৫ হাজারের অধিক জামায়াত-শিবির ও দশ হাজারের মতো বিএনপি নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। এদের অনেকে স্থানীয় এমপিদের ছত্রচ্ছায়ায় কাজ করছে। এদের দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কোণঠাসা। অনেক স্থানে বিশৃঙ্খলার মূল কেন্দ্রবিন্দু এসব হাইব্রিড। ফলে বিভিন্ন স্থানে অনুপ্রবেশকারীদের কারণে দলে খুনের ঘটনা ঘটছে। এ কারণে দলটির তৃণমূল পর্যায়ে হতাশা, উদ্বেগ, আতঙ্ক আর সন্দেহ-অবিশ্বাস বেড়েছে। এসব অনুপ্রবেশকারীর ব্যাপারে দলের হাইকমান্ডও বেশ চিন্তিত। তাদের ব্যাপারে দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে সতর্ক থাকতে কেন্দ্র থেকে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ খুনের ঘটনায় দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অনুপ্রবেশকারীদের সন্দেহ করা হচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং দলীয় কোন্দলও এর কারণ। টেন্ডার দখল, চাঁদাবাজি এবং চোরাচালান সিন্ডিকেটের দখলদারিত্বও রয়েছে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে