ঢাকা, এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ০০:৩৭:০০

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

একীভূত হতে চাওয়া ব্যাংকের সম্পদের দাম যেভাবে নির্ধারণ করা হবে টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথার কারণ নেই : ওবায়দুল কাদের বিএনপি একটি রাজনৈতিক দৈত্যের দল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তি বজায় রাখার জন্য যা-যা করার আমরা করবো: বান্দরবানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবারের ঈদ যাত্রাও স্বস্তিদায়ক হচ্ছে: সেতুমন্ত্রী কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শিশুদের নতুন করে বাঁচার পথ খুলে দেয় : সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ আসন্ন পবিত্র রমজানে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির

সন্তান ধারণের ক্ষমতাও হারালেন তুলসী, ক্যাডাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে

| ১৮ কার্তিক ১৪২২ | Monday, November 2, 2015

img‘রবীন্দ্রকে ওরা মারছিল। তার পোয়াতি বউটা এসে তাকে বাঁচাতে চাইলে তার পেটেও লাত্থি মারলো। আমাদের মেয়েটা আর কোনওদিন মা হতে পারবে না। আমরা কী এমন দোষ করেছি বাপু, এদেশটা কি তাহলে শুধুই ওদের, আমাদের না?’ স্থানীয় ভাষায় এ কথাগুলোই আর্ত কণ্ঠে বলেন ফেনীর মাথিয়ারা জেলেপাড়ার নির্মম নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলার বাদী জহর লাল দাস।

গত বুধবার লক্ষ্মীপূজার রাতে আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর অভিযোগে মাথিয়ারা জেলেপাড়ায় সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলায় এভাবেই আরও অনেকের সঙ্গে নির্মম মারধরের শিকার হন রবীন্দ্র ও তার স্ত্রী তুলসী রানী। এসময় ক্যাডারদের লাথিতে সাত মাসের গর্ভবতী তুলসী রানীর পেটের সন্তানটি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়। আর পরবর্তীতে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তিনি আর কোনওদিন মা হতে পারবেন না।

এসব কষ্টের কথা বলতে বলতে কাঁদতে থাকেন জহর লাল দাস। আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘ওরা সরকারি দল করে, তাই ওদের অনেক ক্ষমতা। সেই ক্ষমতার দাপটে ওরা এসে জেলেপাড়াটা তছনছ করে দিল। সম্রাট আর ইকবালের সঙ্গে ২০/২৫ জন ছিল। তারা অস্ত্র আর লাঠিসোঁটা নিয়ে এসে জেলে পাড়ার সব পুরুষকে মারধর করলো, ঘরবাড়ি-দোকানপাট ভাঙচুর করলো, লুট করে নিয়ে গেলো।’

এলাকাবাসী জানান, বুধবার ( ২৮ অক্টোবর) রাতে ছিল তাদের লক্ষ্মীপূজা। সে উৎসবে পটকা ফোটানোর অপরাধে তাদের ওপর নেমে আসে সরকারদলীয় ক্যাডারদের ভয়াবহ নির্যাতন। এদের নেতা ছিল ইকবাল ও সম্রাট। তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পরেও জেলেদের ওপর নেমে আসে বর্বর নির্যাতন। প্রথম দফায় চলে গেলেও পরে এসে জেলেপাড়ায় নির্মম নির্যাতন চালায় তারা। সেই হামলা ও নির্যাতনে রাতের অন্ধকারে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন জেলেপাড়ার পুরুষরা। অনেকে সপরিবারে নৌকায় চেপে রাত কাটান নদীতে।

সরকারদলীয় সন্ত্রাসী ইকবাল ও সম্রাটের লোকদের হাতে নির্যাতনের শিকার হন তুলসী রানীর স্বামী রবীন্দ্র।
কথা হয় নির্যাতনের শিকার রবীন্দ্র’র সঙ্গে। তিনি জানান, ‘স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ায় ঘর ছাড়তে চাননি তিনি। কিন্তু সন্ত্রাসীরা এসে তাকে নির্মমভাবে পেটাতে থাকে। তাকে মারধর না করার জন্য অনুনয় করেছিলেন তার গর্ভবতী স্ত্রী তুলসী রানী। কিন্তু, এতে মন গলেনি ওদের। উল্টো, তুলসীর পেটে লাথি মেরে বসে এক পাষণ্ড ।’ ধরা কণ্ঠে আর কথা বলতে পারেননি তিনি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সাত মাসের পোয়াতির এখন যমে মানুষে টানাটানি। পেটের সন্তান তো গেছেই, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আর কোনওদিন মা হতে পারবেন না তিনি।

দেয়ালে পিঠ ঠেকায় এ ঘটনায় মামলা করেতে বাধ্য হয়েছেন জহুর লাল দাস। অথচ এত বড় ঘটনার পাঁচ দিন পেরুলেও এখনও শাসকদলীয় ক্যাডারদের  একজনও ধরা পড়েনি। পুলিশ আশ্বাস দিলেও তাই ভীষণ আতঙ্কে আছেন

মাথিয়ারার জেলেপাড়ার নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবার সদস্যরা। ঘটনার পাঁচ দিন পার হলেও তারা কেউই জাল নিয়ে বের হননি কাজের সন্ধানে ।

সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, সন্ত্রাসীদের হামলায় জেলেদের কেউ কেউ গুরুতর আহত। কিন্তু, আতঙ্কের কারণে শরীরের নির্যাতনের ক্ষত নিয়েও তারা বিনা চিকিৎসায় ঘরে মধ্যে বন্দি রয়েছেন ।

চোখের সামনে অন্তঃসত্ত্বা তুলসী রানী দাসের ওপর দুর্বৃত্তদের নির্যাতন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ তার মৃত সন্তান জন্মের করুণ চিত্র কোনও ভাবে ভুলতে পারছেন না তারা ।

মামলার বাদী জহর লাল দাস
শনিবার সরেজমিনে জেলেপাড়ায় নির্যাতিত ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে ।

জেলে পাড়ার বাসিন্দা শোভারানী দাস, রাজকুমার দাস, বিকাশ দাস, জহুর লাল দাসসহ অনেক নারী পুরুষ ও কিশোরদের সঙ্গে আলাপকালে বাংলা ট্রিবিউনকে তারা জানান, বুধবার রাতে লক্ষ্মীপূজায় আতশবাজি ফোটানোর অভিযোগে স্থানীয় সরকারি দলের সমর্থিত দুর্বৃত্ত ইকবাল ও সম্রাট অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করে। এতে তারা তাদের কাছে ক্ষমা চাইলে তারা প্রথমে চলে যায় । এর কিছুক্ষণ পরে আবার তাদের নেতৃত্বে ২০/২৫ জন দুর্বৃত্ত জেলে পাড়ায় ঢুকে বর্বরোচিত হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও তাণ্ডব চালায়।

এতে জেলে পাড়ার ৭০ টি পরিবারের চার শতাধিক নারী, শিশু ও পুরুষ নিরুপায় হয়ে পালাতে থাকে ।

এই সময় দুর্বৃত্তরা প্রতিবন্ধী খোকন দাসের দোকানের মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায় । নিরীহ পরিমল ও রবীন্দ্রের ওপরেও হামলা করে তারা । রবীন্দ্রকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিল তার গর্ভবতী স্ত্রী তুলসী রানী। কিন্তু, ক্ষমতার গরমে পোয়াতি জেনেও দুর্বৃত্তরা তার পেটে লাথি মারে । এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার গর্ভের সন্তান মারা যায় । এই ঘটনায় জেলেপাড়ার  আরও ২০/২২ সদস্য আহত হন ।

এখনও আতঙ্কে মাথিয়ারা জেলেপাড়াবাসী।
ফেনী সদর হাসপাতালে লেবার ওয়ার্ডের ৩ নম্বর সিটে চিকিৎসাধীন নির্যাতিত গৃহবধূ তুলসী রানী দাসের শারীরিক অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক । কর্তব্যরত ডাক্তারেরা জানান, তুলসি রানী তলপেটে আঘাতজনিত কারণে মাতৃত্বের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন ।

স্ত্রীর এ অবস্থা ও অনাগত সন্তানের মৃত্যুর শোকে এখন কাতর রবীন্দ্র দাস । হাসপাতালে তার স্ত্রীর সিটের পাশে দাঁড়িয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে । হতদরিদ্র জেলে রবীন্দ্র আট মাস আগে বিয়ে করেন তুলসীকে । এর মধ্যে তুলসীর গর্ভে আসে তার সন্তান । সেই সন্তান সাত মাস পূরণের আগে এমন পরিণতি হবে তা কোনও ভাবে মেনে নিতে নারাজ তিনি। তার স্ত্রী ও সন্তানের এমন পরিণতির জন্য যারা দায়ী সেই দৃর্বৃত্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

এলাকাবাসী আরও অভিযোগ করেছেন, সন্ত্রাসীদের এই তাণ্ডব চলাকালে তাদের সহায়তায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ কোনও মানুষই এগিয়ে আসেননি । ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে তারা বাড়ি ফিরে আসেন বলে জানান।

তারা অভিযোগ করেন, এই ঘটনার মূল হোতা ইকবাল ও সম্রাটকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। তাদের রক্ষকেরাও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে । নানা অজুহাতে বিভিন্ন সময় তাদের পরিবারের ওপর নির্যাতন চালানো হলেও তা নীরবে সহ্য করে নেন । কারণ, প্রতিবাদ করলে

আরও ভয়াবহতা নেমে আসতে পারে ।

এই ঘটনায় মামলার বাদী  জহুর লাল দাস বলেন, দুর্বৃত্তদের অন্যায় সইতে সইতে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে । এখন নিরুপায় হয়ে মামলা করেও আতঙ্কে আছি । তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যারা এ ঘটনা ঘটালো সরকারি দলের লোক হওয়ায় তাদের সঙ্গে সবাই আছে । আর আমরা গরীব ও হিন্দু, আমাদের বিপদে কেবা থাকবে!

এই অবস্থায় প্রশাসনের পক্ষ হতে সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আশ্বাসে আমরা ভরসা পাচ্ছি না।

নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবারের নিরাপত্তায় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়ে ফেনী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মাহবুব মোর্শেদ জানান, ঘটনার মূল হোতা  ইকবাল ও সম্রাটকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান এই  ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও নির্যাতিতদের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুরোধ করেছেন তিনি।