ঢাকা, এপ্রিল ২৬, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ০৯:১৫:৫২

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

একীভূত হতে চাওয়া ব্যাংকের সম্পদের দাম যেভাবে নির্ধারণ করা হবে টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথার কারণ নেই : ওবায়দুল কাদের বিএনপি একটি রাজনৈতিক দৈত্যের দল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তি বজায় রাখার জন্য যা-যা করার আমরা করবো: বান্দরবানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবারের ঈদ যাত্রাও স্বস্তিদায়ক হচ্ছে: সেতুমন্ত্রী কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শিশুদের নতুন করে বাঁচার পথ খুলে দেয় : সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ আসন্ন পবিত্র রমজানে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির

রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে

| ২৩ চৈত্র ১৪২৪ | Friday, April 6, 2018

রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে

সি নিউজ : বিশ্বে যত ধর্ম আছে তার সবই মানবতার শান্তি ও কল্যানের জন্য। জীব হত্যা মহাপাপ-এটি প্রায় সকল ধর্ম মানে। তারপরও মিয়ানমারে নির্বিচারে চলছে সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গা নিধন। অথচ বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে অহিংসার ধর্ম এবং জীবহত্যা নিষিদ্ধ বলা হয়ে থাকে বৌদ্ধ ধর্মের মূল দর্শন।মিয়ানমারের অন্যতম বড় সমর্থক রাষ্ট্র হলো চীন। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমার সরকার অনেক ক্ষেত্রে এ দেশটির হাতের পুতুল।
সেক্ষেত্রে শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সুচি চীনা ডল বা চীনা পুতুলের ভূমিকা পালন করছেন। সন্ত্ রাসবাদ ঠেকানোয় তার কোন ভূমিকা নেই সেখানে। শান্তি ও মানবতাকে গলা টিপে হত্যা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সন্ত্রাসীদের বর্বরোচিত কার্যকলাপে পুতুলের  মতো নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন সুচি ।বাঙালী নতুন প্রজন্ম একাত্তরের গৌরবগাঁথা সংগ্রাম আর সেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখেনি।তারপর যখন থেকে বাবা, মা, দাদা, দাদী বা বয়োজ্যেষ্ঠ কারো মুখ থেকে শুনেছে, শিউরে উঠেছে ভয়ঙ্কর সেই নীপিড়ন আর নির্যাতনের ইতিহাস শুনে। তারপর পাঠ্যপুস্তক, জাতীয় দৈনিক অথবা টেলিভিশনে প্রদর্শিত নাটক কিংবা ছায়াছবিতে মুক্তিযুদ্ধ সমন্ধে জেনেছে।এভাবে অবলোকন করেছে কি ভয়াবহ পাকিস্তানী সেনা কর্তৃক এদেশের নিরীহ জনসাধারনের উপর পৈশাচিকতা, নৃশংসতা আর বিভীষিকাময় সেই নারকীয়তার ইতিহাস!
খুন, জখম, লুটপাত, নারীর প্রতি পাশবিক নির্যাতন, বসতভিটায় আগুন এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বর্বরোচিত আক্রমন, গণহত্যা ইত্যাদি পৃথিবীর ইতিহাসে রচনা করেছিল তারা; একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
সেই ইতিহাসের যেন পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৪ আগস্টের পর থেকে সামরিক বাহিনী কর্তৃক হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলমান নিহত হয়েছে। এদের সঠিক সংখ্যা এখনো নিরূপণ করা যায় নি। অসহায়, নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রাণ বাঁচাতে সুদীর্ঘ ও দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। রোহিঙ্গাদের এখন প্রবল আহাজারি আর বেঁচে থাকার আঁকুতি। সেইসাথে বুকে দুঃসহ কালো অভিশপ্ত স্মৃতি আর চরম অনিশ্চয়তা সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গাদের। যা টেলিভিশনের পর্দায় অথবা খবরের কাগজে প্রতিদিনই শিরোনাম হচ্ছে। তারা জানিয়েছে কতটা নিপীড়ন তারা সহ্য করেছে, চোখের সামনে দেখেছে। খুনের নেশায় মত্ত সেনাবাহিনী ও রাখাইন সন্ত্রাসীরা তাদের বাবা, দাদার বয়সী মানুষগুলোকেও রেহাই দেয়নি। পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে হতভাগ্য নারীদের উপর। অবুঝ শিশুর বুকে গুলি চালিয়ে রক্তের হলি খেলায় মেতেছে বর্বর, পিশাচরূপী মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নাফ নদীর বুকে ভেসে ওঠা রক্তাত্ত শিশুর লাশ গোটা পৃথিবী দেখে থমকে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মারফত অথবা ইলেকট্রনিকস মিডিয়াতে অবলোকন করে।বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন সীমানায় বসবাসকারী মানুষ! শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটের কল্যানে রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলীমদের ওপর যেসব বর্বও পশাচিক হামলা তারা করছে, তার বিভৎস ছবি; ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, নরনারীদের মাথা থেতলে দেয়া, কখনোবা তাদের দেহের পোঁড়া বা কাঁটা অংশের ছবি সারা পৃথিবীর মানুষ দেখছে আর শিউরে উঠেছে।
এরমধ্যে একটি বিভৎস ঘটনার উদাহরণ দেয়া যায়, “উখিয়ার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে আশ্রয় নেয়া শামসুল আলম নামের এক রোহিঙ্গা বলছিলেন নিজের ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধ বাবা ও তিন শিশু সন্তানকে নির্মমভাবে জবাই হতে হয়েছে তারই চোখের সামনে। সারাজীবন এ বিভৎস স্মৃতি তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। জনৈক রোহিঙ্গা নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নিয়ে তার  স্বামী ও তিন সন্তানকে আগুনে ফেলে দিয়েছে পাষন্ড সেনারা। এরূপ অসংখ্য ঘটনা আর দুঃসহ স্মৃতির বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে সীমান্তবর্তী নোম্যানসল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা। আর বাংলাদেশে যখন তারা অনুপ্রবেশ করেছে পেছন ফিরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেছে, ফেলে আসা তাদের প্রিয় স্বজনদের যা তারা হারিয়ে এসেছে । বেঁচে ফিরেও তাদের দুর্বিষহ যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি হয়নি। স্থলপথে সেনারা মাইন পুঁতে রেখেছে। এই মাইনের কথা অনেকেই জানেনা। যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় এটি পুঁতে রেখে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তেমনি ছোট বড় চিপসের বা বিস্কুটের প্যাকেট বা মোবাইল সেট দিয়ে তাতে জঘন্যতম মরণ ফাঁদ এই মাইন পুঁতে রেখেছে সেনারা। পরে সেটা বিস্ফোরিত হয়ে অনেক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। ফলে এসব দুর্ঘটনা এড়াতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা সেন্টমার্টিন সংলগ্ন নাফ নদী পাড়ি দিচ্ছে ছোট ছোট নৌকাযোগে।কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি । কত বাবা মায়ের কোল থেকে তাদের প্রিয় শিশু পড়ে গিয়েছে আর তাকে পাওয়া যায়নি। এভাবে সন্তান, ভাই অথবা বোন, বাবা মা আর কতো স্বজন হারা হয়েছে অসহায় রোহিঙ্গারা। প্রিয় স্বজনদের হারিয়ে পাগলপ্রায় রোহিঙ্গাদের চিৎকারে আকাশ বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে।
রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, তাদের প্রিয় মাতৃভূমি রাখাইন রাজ্যে এখন কেবল লাশের গন্ধ, তাদের ঘরবাড়ি, তিলে তিলে গড়া তাদের সংসার, ক্ষেত খামার, গোয়াল ভরা গরু, কারো বা জমিদারবাড়ি বৌদ্ধ মিয়ানমার সেনা ও সন্ত্রাসীদের হিংসার আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। সেনাদের বর্বরতার মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কোনক্রমেই তাদের ভিটেমাটিতে ফিরে যেতে চাইছে না।
বাংলাদেশের সীমান্ত যদি খুলে না দেয়া হতো তাহলে তারা আর বেঁচে ফিরতো না বলে অনেক রোহিঙ্গাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ এ দুর্দিনে তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে এক মহান ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বন্যা, পাহাড় ধস, রোগব্যাধিসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমি যেন সংগ্রাম করেই চলেছে।
তার মধ্যে নতুন সংকট রোহিঙ্গা ইস্যু মোকাবেলা করতে হচ্ছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সরকারকে একটি প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেটি ছিল প্রতিবেশী দেশ হিসেবে দুই দেশের সংযোগকারী সীমান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। উল্লেখ্য, প্রস্তাবটি জাতিসংঘ,আসিয়ান, আইসিআরসি এবং ওআইসির মাধ্যমে করা হয়েছিল।
কিন্তু মিয়ানমার সরকার তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করে। ইতিপূর্বে রোহিঙ্গাদের উপর সহিংসতা বন্ধের জন্যে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করলেও সে দেশের সরকার সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে। মিয়ানমার সরকারের এরূপ গোয়ার্তুমি ও একরোখা আচরণ খুবই অমানবিক ও নিন্দনীয়।
রাখাইন রাজ্য প্রায় রোহিঙ্গাশূন্য। বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা আট লাখের উপর। বাংলাদেশের মতো জনবহুল একটি দেশের পক্ষে  ক্রমবর্ধমান রোহিঙ্গা মুসলিম জনসংখ্যার চাপ সামলানো খুব সহজ ব্যাপার নয়।
তাছাড়া এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ দেশে স্থান দেয়ার কোনো সুযোগও নেই। কারণ সম্পদ ও স্থান বিচারে বাংলাদেশের তুলনায় মিয়ানমার শতগুন বড়।
কাজেই সেখানে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের স্থান সাংকুলানে কোনো ধরনের সমস্যা হবার কথা নয়। অথচ সে দেশের সরকার এমন আচরণ করছে যেন সংখ্যালঘু মুসলমানদের তারা দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারলেই বাঁচে।
যে কারণে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের পুরোদমে লেলিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে উৎক্ষাত করার ষড়যন্ত্রে নেমেছে।
আর একটি ব্যাপার উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ ছাড়াও সীমান্ত রয়েছে ভারত, চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডের। অথচ জাতিসংঘ কেবল বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের জন্যে সীমান্ত খুলে দেয়ার অনুরোধ করে।
যার পেছনে পশ্চিমাদের কূটকৌশল জড়িত থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতের অনেকেই বারবার কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে কেবলমাত্র বাংলাদেশকেই সবক দিয়ে যাচ্ছেন।অথচ  মিয়ানমারের সাথে কোনোরূপ আলোচনা করে তাদের এ বিষয়ে কেন জোরদার পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা যাচ্ছে না সেটি একটি প্রশ্ন। বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমা শক্তিশালী দেশগুলোর কুনজর থাকতে পারে বলে মনে করা হয়, তাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশে একটি মহল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করছে। অতএব, পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এতবড় একটা সংকট সমাধানের পথ কেবল বাংলাদেশের একার হাতে নেই। বাংলাদেশ আক্রান্ত মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবে। যতটুকু সম্ভব তাদের খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রীসহ নানা সুবিধা দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করবে। কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান বাংলাদেশ একা করে দিতে পারবে না। এই কঠিন সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের উচিত হবে বিশ্বদরবাওে বিষয়টি গুরুত্বেও সাথে তুলে ধরা।
সে অনুসারে জাতিসংঘে বৈঠকের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে বিভিন্ন শক্তিকে বিষয়টি জোরালোভাবে অবহিত করে সমাধানের সুষ্ঠু পথ তৈরি করতে হবে।

হাসিনা সাঈদ মুক্তা
লেখক ও সাংবাদিক