“বাজল তোমার আলোর বেনু ,মাতল রে ভুবন
আজ প্রভাতে , সে সুর শুনে, খুলে দিনু মন”
শরতের শিশির ভেজা ঘাসে অরুণ রাঙা চরণ ফেলে দেবীপক্ষের সূচনা, চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে মর্ত্যালোকে আমন্ত্রণ দেবী দুর্গাকে। কাশ ফুলের দোলায়, সবুজ ঘাসের ওপর শিউলি ফুলের গালিচায় চোখ মেললেই দেখতে পাই মা এর আগমনী বার্তা । শ্রীশ্রী চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই মহালয়া হিসেবে পরিচিত। মহালয়া শব্দের আক্ষরিক সমার্থ হলো ‘আনন্দ নিকেতন’।দেবীপক্ষের সূচনা হয় পূর্ববর্তী অমাবস্যার দিন; এই দিনটি মহালয়া নামে পরিচিত। অন্যদিকে দেবীপক্ষের সমাপ্তি পঞ্চদশ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমায়; এই দিনটি কোজাগরী পূর্ণিমা নামে পরিচিত ও বাৎসরিক লক্ষ্মীপূজার দিন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্গাপূজা মূলত পাঁচদিনের অনুষ্ঠান হলেও মহালয়া থেকেই প্রকৃত উৎসবের সূচনা ও কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় তার সমাপ্তি।ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা প্রতিপদ থেকে আশ্বিনের কৃষ্ণা পঞ্চদশী, অর্থাৎ অমাবস্যা অবধি প্রেতলোক থেকে পিতৃপুরুষের আত্মারা মর্ত্যলোকে ফিরে আসেন নিজের ছেড়ে দেয়া গৃহ-পরিজনের মায়ায়। মহালয়ায় তাদের সবার আবির্ভাব সম্পূর্ণ হয় বলেই সেই দিনটিতে তর্পণের মাধ্যমে তাদের পরিতৃপ্ত বিধান করে প্রতিটি গৃহেই আনন্দোৎসব পালনের বিধি আছে। আলয় যেদিন মহময় অর্থাৎ আনন্দময় হয়ে ওঠে, সেই দিনই হলো মহালয়া। মহালয়ার গুরত্ব অপরিসীম l আশ্বিনের অমাবস্যার এই মহালয়া নামটির উৎসের মধ্যেই এর ধর্মীয় সংস্কারগত তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়।
ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য, আসল দূর্গা পূজা হতো বসন্তে , সেটাকে বাসন্তি পূজা বলা হয় । শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয় ।
সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে , বিবাহ করতে গেলে প্র্রয়াত পূর্বরা, যাদের পিতা-মাতা তাদের পিতা-মাতার জন্য , সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয় । তর্পণ মানে খুশি করা । ভগবান শ্রীরাম লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন । সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরন করে, পূর্বপূরুষের আত্নার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন ।
সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্নাদের মত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্নার যে সমাবেশ হয় তাহাকে মহালয় বলা হয় । মহালয় থেকে মহালয়া । পিতৃপক্ষের ও শেষদিন এটি এবং দেবীপক্ষের সূচনা । আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষ বা পিতৃপক্ষের প্রতিদিনই পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করার রীতি সময়ে প্রচলিত ছিল। শ্রদ্ধাসহকারে যে অন্নজল নিবেদন করা হয়, তা-ই শ্রাদ্ধ। সব মিলিয়ে মহালয়া মূলত পূর্বপুরুষের পূজার বিশেষ তিথি। হিন্দু সংস্কৃতির ইতিহাসে অত্যন্ত পুরাতন একটি বিশ্বাসের লব্ধ ফল। মহালয়ার মতো উৎসব স্মরণাতীতকাল থেকেই প্রচলিত।
সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করতে হয় , সেই তিথিতে করতে হয় যে তিথিতে উনারা প্রয়াত হয়েছেন । সনাতন ধর্মের কার্যাদি কোন তারিখ অনুসারে করা হয় না । তিথি অনুসারে হয় ।
মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্নার শান্তির জন্য , তাহারা শুধু পূর্বদের নয় , পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন ।
যে-অবান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা - অর্থাৎ যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু ও , যারা জন্ম জন্মাত্নরে আমার আত্নীয় বন্ধু ছিলেন , তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহন করুন, যাদের পুত্র নেই , যাদের কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদের জন্য ও অঞ্জলী প্রদান করতে হয় ।
যেযাং, ন মাতা, ন পিতা, ন বন্ধু - অর্থাৎ যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদেরকে ও স্মরন করছি ও প্রার্থনা করছি তাদের আত্না তৃপ্তিলাভ করুক ।
মাগো, তোমার ওই শ্রীচরণতলে আমাদের সকলকে স্থান দিও। আমাদের সুখ-দুখ্য ভরা এই মেদিনীতে তোমার মধুর গানে আনো শান্তির বার্তা; তোমার ঈশ্যর চেতনার স্পর্শে নামিয়ে আনো আনন্দের ধারা।
“আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে”॥ এ আনন্দের উষ্ণতা সেই ছোটবেলা থেকেই একইভাবে গেথে আছে মম হৃদয়ে
“যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরুপেন সংস্থিতা নমস্থ্যৈ নমস্থ্যৈ নমস্থ্যৈ নমো নম: যা দেবী সর্বভূতেষু জাতিরুপেন সংস্থিতা নমস্থ্যৈ নমস্থ্যৈ নমস্থ্যৈ নমো নম:”
আকাশবাণীর “মহিষাসুর-মর্দিনী” শুনতে শুনতে সেই সকালেই জেনে যেতাম, সেদিন মহালয়া। মা মহালয়ার দিন পা রাখবেন মর্তলোকে, পূজোর আর মাত্র আট দিন বাকি। সর্বশক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া।
বিশ্বশান্তিকল্পে প্রার্থনা জানাচ্ছি :
সর্ব্বেষাং মঙ্গলং ভূয়াৎ সর্বেসন্তু নিরাময়ঃ।
সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ ভবেৎ ॥
তুমি সর্বেশ্বরী, সবার অধিশ্বরী, তুমি সর্বশক্তিময়, তুমি সবার দুঃখ-কষ্ট-ভয়, আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা করো।
শুভ মহালয়া যারা ওপারে চলে গেছেন তাদেরকে ও স্মরন করছি ও প্রার্থনা করছি তাদের আত্না তৃপ্তিলাভ করুক ।
সকলেই সুখি হোক ।
রুদ্ধ মনের খুলে এলো খুশির জোয়ার,
সময় এলো নতুন ভাবে নতুন মন ছোয়ার,
নয়ন মাঝে মেঘের আলো পুরো মনের ইচ্ছা
সকলকে “শারদ শুভেচ্ছা”