ঢাকা, মে ৬, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১১:০৯:১৪

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

একীভূত হতে চাওয়া ব্যাংকের সম্পদের দাম যেভাবে নির্ধারণ করা হবে টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথার কারণ নেই : ওবায়দুল কাদের বিএনপি একটি রাজনৈতিক দৈত্যের দল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তি বজায় রাখার জন্য যা-যা করার আমরা করবো: বান্দরবানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবারের ঈদ যাত্রাও স্বস্তিদায়ক হচ্ছে: সেতুমন্ত্রী কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শিশুদের নতুন করে বাঁচার পথ খুলে দেয় : সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ আসন্ন পবিত্র রমজানে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির

বাবা দিবস,বাবার আশীর্বাদ জীবনের পাথেয়

| ৪ আষাঢ় ১৪২৪ | Sunday, June 18, 2017

 

আজ ১৮ জুন ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। ইংরেজিতে ফাদার বা ড্যাড, জার্মানিতে ফ্যাটা, বাংলায় বাবা কিংবা ভারতীয়দের ভাষায় পিতাজি—যে নামেই ডাকা হোক না কেন, পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা একই রকম। এ জন্য জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বের প্রায় ৭৪টি দেশে বাবা দিবস উদযাপিত হয়। তৃতীয় রোববার হিসেবে এ বছর আজ উদযাপিত হচ্ছে বাবা দিবস। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর জন্যই এ দিবস। যদিও বাবার প্রতি সন্তানের চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। তার পরও পৃথিবীর মানুষ বছরের একটা দিনকে বাবার জন্য রেখে দিতে চায়। যেমনটা মায়ের জন্য ‘মা দিবস’ আছে।

২.

এ দিনটি সামনে রেখে আমাদের ছাত্র ফেরদৌস হাসান রাসেল তার বাবার গল্প করছিল। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা। বড় সন্তান হিসেবে ফেরদৌস তার বাবার অপত্য স্নেহের কথা বলছিল বারবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কিংবা যেকোনো সংকটে বাবার ছায়াতলে আশ্রয়ের কথা স্মরণ হলে ওর চোখ আর্দ্র হয়ে আসে। বেকার জীবনে পিতা তার চাকরি পাওয়ার প্রতীক্ষায় আছেন, আশায় বুক বেঁধে ওর জন্য পারিবারিক জমি বন্ধক রেখেও সংসার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে, আমাদের ছাত্রী মিশু খুবই বাবা অন্তপ্রাণ। নরসিংদীর মেয়ে ঢাকায় মেসে থেকে লেখাপড়া চালাচ্ছে। ভালো ছাত্রী। কিন্তু তার নিজ বাড়িতে বাস করা বাবার জন্য সে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকে। আর পিতার নানা নির্দেশ মেনে চলতেও বাধ্য সে। বেশি ঘোরাফেরা করবে না, কাউকে সঙ্গে না নিয়ে দূরে যাবে না, এ রকমভাবে বাবার আরো কত কথা তার শিক্ষাজীবন ঘিরে আছে সব সময়। ‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়।’ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া এই গান মিশুকে এক অসীম নস্টালজিয়ায় ডুবিয়ে দেয়। ছাত্রজীবনে তন্দ্রার অবশ্য বিয়ে করাটা মেনে নিতে পারেনি ওর বড় ভাইয়া। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর ঠিকই তার পিতা কথা বলেছে মেয়ের সঙ্গে, রাগ করে দূরে থাকতে পারেননি। আর জ্যোৎস্না তার পিতার শাসন-বারণ ও পিটুনির কথা শুনিয়ে তারপর বলছিল ওর পিতার স্নেহ ও যত্নের গল্প। বিশেষত বাল্যকালে ও যখন অসুস্থ হতো, তখন বুঝত পিতা কতটা তাকে ভালোবাসেন। কত রাত জেগে তার পাশে বসে থাকতে দেখেছে বাবাকে। আমাদের ছাত্র আপন, সেই যে পিতৃহীন ছেলেটা লিভার ক্যানসারে ৯ জুন মারা গেল, সেও হয়তো বাবার কথা ভেবে কষ্ট পেত। অন্যদিকে সাংবাদিক এস এম আল-আমীনের বাবা ফরিদপুরের গ্রামে থাকলেও ঢাকা শহর তথা দেশের রাজনীতি নিয়ে ছেলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়ে থাকেন। ছেলেও সংবাদ লেখায় বাবার মতামতগুলো উল্লেখ করে নির্দ্বিধায়।

আমার বাবা ছিলেন সরকারি স্কুলের শিক্ষক। ছয় ভাইবোনের খাবার জোটাতে তাঁকে অপরের কাছ থেকে ঋণ করে সংসার চালাতে দেখেছি। এমনকি আমাদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে তাঁকে বাস্তুভিটা বিক্রি করতে হয়েছে। পিতার স্বভাব কিছুটা হলেও আমি পেয়েছি। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ঋণ করে চলাও আমার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর মিথ্যা কথা না বলা, সাধারণভাবে জীবনযাপন করা, বিলাসিতা বর্জন করা বাবার কাছ থেকে শিখেছি। বাবার আশীর্বাদ ও উৎসাহ না পেলে লেখার কাজেও এগিয়ে আসতে পারতাম না। কথায় বলে, বটবৃক্ষ কিংবা নিদাঘ সূর্যের তলে সন্তানের কোমল-শীতল ছায়া হলেন বাবা। বাইবেলে আছে, ‘কারো সন্তান যদি রুটি চায়, তাহলে সেই পিতা কি তাকে পাথর দেবে? কখনো নয়।’ কারণ পিতা সন্তানের জন্য তাঁর জীবনের সবটুকু উৎসর্গ করে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে দেন।

৩.

ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে জানা যায়, বাবা দিবসের প্রচলন বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই প্রথম বাবা দিবস পালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় প্রথম এ দিবস পালন করা হয়। আবার সনোরা স্মার্ট ডড নামে ওয়াশিংটনে এক নারীর মাথায়ও বাবা দিবসের আইডিয়া আসে। যদিও তিনি ১৯০৯ সালে ভার্জিনিয়ার বাবা দিবসের কথা একেবারেই জানতেন না। ডড এই আইডিয়া পান গির্জায় এক পুরোহিতের বক্তব্য থেকে, সেই পুরোহিত আবার মাকে নিয়ে অনেক ভালো কথা বলেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, মায়ের পাশাপাশি বাবাদের নিয়ে কিছু করা দরকার। ডড আবার তাঁর বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন পরিবারের ছয় ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র মেয়ে। মার্কিন গৃহযুদ্ধে তাঁর বাবা অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময় তাঁর মা সবাইকে নিয়ে ওয়াশিংটনের স্পোক্যানে চলে আসেন। ডডের বয়স যখন ষোলো, তখন তাঁর মা ষষ্ঠ সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। সেই থেকে বাবার ওপর তাঁর নির্ভরতা বেড়ে যায়। তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই ১৯১০ সালের ১৯ জুন বাবা দিবস পালন শুরু করেন। ১৯১৩ সালে আমেরিকার সংসদে বাবা দিবসে ছুটি ঘোষণার জন্য একটি বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে সে সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। পরে ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লেন্ডন বি. জনসন প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত দেন। ছয় বছর পর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের স্বাক্ষরের মাধ্যমে আইন করে দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ১৯৭২ সালে।

মে মাসের দ্বিতীয় রোববার যেমন ‘বিশ্ব মা দিবস’ পালিত হয়, তেমনি এ দেশেও ‘বাবা দিবস’ বেশ ভালোভাবেই উদযাপন করা হচ্ছে। দেশের মিডিয়া ও ফ্যাশন হাউসগুলো দিবসটি ঘিরে নতুন পোশাক বাজারে নিয়ে আসে। সন্তান বাবাকে নানা রকম উপহার দিয়ে দিনটি পালন করে। বাবা মানেই কর্মব্যস্ত একজন মানুষ। বাইরে থেকে ফিরে যিনি সন্তানকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে ভুলে যেতে পারেন সারা দিনের ক্লান্তি। ‘বাবা দিবসে’ মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের কথা। রবীন্দ্রনাথ এ গল্পে পিতৃ হৃদয়ের স্নেহকে ধর্ম-বর্ণ-দেশের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। আফগান কাবুলিওয়ালা রহমতের পিতৃত্বের মহিমা বাঙালি পিতার বাৎসল্যকেও হার মানিয়েছে। তাই মিনির বাবার মতে, “দেখিলাম, কাগজের উপর একটি ছোট হাতের ছাপ। ফটোগ্রাফ নহে, হাতে খানিকটা ভূষা মাখাইয়া কাগজের উপরে তাহার চিহ্ন ধরিয়া লইয়াছে। কন্যার এই স্মরণচিহ্নটুকু বুকের কাছে লইয়া রহমত প্রতি বৎসর কলিকাতার রাস্তায় মেওয়া বেচিতে আসে-যেন সেই সুকোমল ক্ষুদ্র শিশু হস্তটুকুর স্পর্শখানি তাহার বিরাট বিরহী বক্ষের মধ্যে সুধাসঞ্চার করিয়া রাখে।” পরক্ষণে মিনির বাবা বুঝতে পারলেন, “সেও যে আমিও সে, সেও পিতা আমিও পিতা।” সন্তানের জন্য পিতার এই হাহাকার দীর্ণ হৃদয়ের চিত্রণ চিরন্তন, অনবদ্য।

৪.

বাবা দিবসে আমাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হোক—বাবা আমরা তোমাকে ভালোবাসি। যে দায়িত্ব নিয়ে তুমি আমাদের মানুষ করে তুলেছ, আমরা তা ভুলিনি, ভুলব না কোনোদিন। আমাদের জীবনযুদ্ধের সেনাপতি তুমি। বর্তমান শতাব্দীতে মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। সন্তানরাও বড় হয়ে পৃথক স্থানে বসবাস শুরু করে কিংবা কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে; বাবার স্নেহের কথা ভুলে যায়। কেউ কেউ উপার্জন-ক্ষমতাহীন বৃদ্ধ বাবাকে বোঝা ভাবতে থাকে। কিন্তু আসলে কোনো সন্তানই কখনো বাবাকে ভুলে থাকতে পারে না। কারণ, পিতার আশীর্বাদেই সন্তানের পথচলা শুরু হয়। একজন বাবা তাঁর অর্জনটুকু প্রিয় সন্তানের জন্য উৎসর্গ করেন। এ জন্য পিতার মমতাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই প্রতিবছর পালিত হয় ‘বাবা দিবস’।

লেখক : মিল্টন বিশ্বাস,অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।