ঢাকা, মে ৩, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১৫:০১:৩০

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

একীভূত হতে চাওয়া ব্যাংকের সম্পদের দাম যেভাবে নির্ধারণ করা হবে টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথার কারণ নেই : ওবায়দুল কাদের বিএনপি একটি রাজনৈতিক দৈত্যের দল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তি বজায় রাখার জন্য যা-যা করার আমরা করবো: বান্দরবানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবারের ঈদ যাত্রাও স্বস্তিদায়ক হচ্ছে: সেতুমন্ত্রী কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শিশুদের নতুন করে বাঁচার পথ খুলে দেয় : সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ আসন্ন পবিত্র রমজানে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির

পহেলা বৈশাখ পালিত হোক একই দিনে

| ২ বৈশাখ ১৪২৪ | Saturday, April 15, 2017

Image result for বঙ্গাব্দ ও পহেলা বৈশাখের ইতিহাস

অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও নিত্য হিসাব চলে গ্রেগরিয়ান বা পশ্চিমা বা খৃস্টিয় পঞ্জিকা মেনে। পাশাপাশি বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন বা ফসলি সন ও হিজরি সালের আছে যথাব্যবহার। বাংলাদেশের বাঙালিরা ছাড়াও অন্যান্য জাতি, উপজাতি, সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিভিন্ন নামে বঙ্গাব্দের ব্যবহার আছে। এ অব্দ বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও সরকারিভাবে স্বীকৃত। এ ছাড়া এর প্রচলন কিছুটা অন্যভাবে আছে ভারতের বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম, মণিপুর, ত্রিপুরা, ওড়িশা, তামিল নাড়ু, কেরল, পাঞ্জাব প্রভৃতি রাজ্যে; নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, লাওস, কমবোডিয়া প্রভৃতি দেশে। কিন্তু ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশ যখন বঙ্গাব্দ অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপন করছে সেদিন পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য অঞ্চলে পালিত হচ্ছে চৈত্রসংক্রান্তি অর্থাৎ বছরের শেষ দিন। তারিখের এমন গড়বড় আরও হবে ২৫শে বৈশাখ, ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ২২শে শ্রাবণ- বাঙালিদের প্রিয় আরও অনেক তারিখে। এর কারণ বাংলাদেশে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার।

ঘটনার শুরু ষাটের দশকে। বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের চিন্তা দেখা দেয় বিশারদ মহলে। এর কারণ প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকায় বাংলা মাসের দিনগণনা গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকার মতো সুনির্দিষ্ট নয়। গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকায় ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে, বাকি ১১ মাস ৩০ ও ৩১ দিনে বিভক্ত। লিপইয়ার বা অধিবর্ষে ফেব্রুয়ারি মাস গণনা করা হয় ২৯ দিনে। প্রচলিত বাংলা পঞ্জিকায় মাসের দিন সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় একেক বছরের গণনা হয় একেক রকম। কোনও বছর জ্যৈষ্ঠ মাস ৩১ দিন, কোনও বছর ৩২ দিন। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র মাসেও একই অবস্থা। আবার অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন কোনও বছর ২৯, কোনও বছর ৩০ দিন। চৈত্র ও বৈশাখ মাস কোনও বছর ৩০, কোনও বছর ৩১ দিন।

এ জন্য পণ্ডিতদের গণনা দ্বারা নির্ণীত পঞ্জিকা প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ব্যবহারকারীদের। তারপর আছে পণ্ডিতদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে মতভেদ, গণনা নিয়ে বিতর্ক, ভুল ও অন্যান্য সমস্যা। গুপ্ত প্রেস, সিদ্ধান্ত ও লোকনাথ পঞ্জিকার গণনাভেদ নিয়ে প্রায়ই দেখা দেয় নানা বিপত্তি। বিবাদও ঘটে এ নিয়ে। এ অবস্থায় ‘বাংলা পঞ্জিকার সংস্কার অত্যাবশ্যকীয়’ হয়ে পড়ায় বাংলা একাডেমি ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার উপসংঘ’ গঠন করে ১৯৬৩ সালে। উপসংঘের প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ; সদস্য ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম, পণ্ডিত তারাপদ ভট্টাচার্য (কাব্যব্যাকরণপুরাণস্মৃতিতীর্থ, ভাগবতশাস্ত্রী, সাহিত্যোপাধ্যায় - স্মৃতিপুরাণরত্ন, জ্যোতিষশাস্ত্রী), পণ্ডিত অবিনাশচন্দ্র কাব্যজ্যোতিতীর্থ, পণ্ডিত সতীশচন্দ্র শিরোমণি জ্যোতিভূষণ ও সৈয়দ আলী আহসান (পরিচালক, বাংলা একাডেমি)। তিন বছর পর, ১৯৬৬ সালে, উপসংঘ ঘোষণা করে তিনটি সংস্কার:

এক. বাংলা মাস গণনার সুবিধার জন্য বৈশাখ থেকে ভাদ্র প্রতি মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র প্রতি মাস ৩০ দিন হিসাবে গণনা করা হবে। দুই. অধিবর্ষে (লিপ ইয়ারে) চৈত্র মাস হবে ৩১ দিনে। ৪ দিয়ে বিভাজ্য সাল হবে অধিবর্ষ। তিন. সম্রাট আকবরের সময়ে সূচিত বঙ্গাব্দ অনুযায়ী বছর গণনা হবে; ওই হিসাবে আগামী ১লা বৈশাখ হবে ১৩৭৩ সাল।

পশ্চিমবঙ্গসহ অনেক জায়গায় আজ চৈত্রসংক্রান্তি পালিত হচ্ছে

ঘোষণার পর ১৩৭৩ থেকে ১৩৭৭ পর্যন্ত নতুন গণনা পদ্ধতির বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। এরপর ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের (১৯৭৬-৭৭) দেয়াল পঞ্জিকা প্রকাশ করেছিলেন তারা। কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা ও স্থানীয় পঞ্জিকা অনুসরণ করে পদ্ধতিটি। ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি সরকার নির্দেশ দেয়, সরকারি কাজকর্মে গ্রেগরিয়ান সন-তারিখের পাশাপাশি বাংলা সন-তারিখও লিখতে হবে। ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন মন্ত্রীপরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি ঘোষিত বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হবে সরকারিভাবে। সেই থেকে সকল মন্ত্রণালয়, বিভাগ, পরিদফতর ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা শুরু করে ওই নির্দেশ পালন। তাহলেও ২১ ফেব্রুয়ারি (শহীদ দিবস), ২৬ মার্চ (স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস), ১৬ ডিসেম্বর (বিজয় দিবস) পালিত হয় গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা মতে। তবে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র জয়ন্তী ২৫শে বৈশাখ, নজরুল জয়ন্তী ১১ই জ্যৈষ্ঠ, রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবস ২২শে শ্রাবণ, নজরুলের মৃত্যুদিবস ১২ই ভাদ্র পালিত হয় নতুন বাংলা পঞ্জিকা মতে।

১৩৯৫ বঙ্গাব্দে (১৯৮৮-৮৯ সালে) নতুন বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের পর নানান মত প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে। বিষয়গুলো বিবেচনার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে বাংলা একাডেমি। এ কমিটি পর্যালোচনা করে মুহম্মদ তকীয়ুল্লাহ, জি এম আনিসুর রহমান, ড. মসিউর রহমান ও জামিল চৌধুরীর দেওয়া সুপারিশগুলো। কমিটিতে সদস্য ছিলেন প্রফেসর হারুন-অর-রশিদ, প্রফেসর এম শমশের আলী, প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম, ড. আলী আসগর, ড. অজয় রায়, ম ম শহীদুল্লাহ প্রমুখ। তারা সুপারিশ করেন :
এক. বৈশাখ থেকে ভাদ্র প্রতি মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র প্রতি মাস ৩০ দিন গণনা করা হবে। দুই. গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাসে পড়বে সেই বাংলা বছর অধিবর্ষ হবে। তিন. অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস হবে ৩১ দিনে।

এই সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৯৬ অব্দ মোতাবেক ১৪০২-১৪০২ বঙ্গাব্দের বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে সরকার। এতে ১৪০২ সালকে অধিবর্ষ হিসাবে ফাল্গুন মাসকে গণনা করা হয় ৩১ দিন।
বাংলা পঞ্জিকার সংস্কারের ফলে বাংলা ও গ্রেগরিয়ান তারিখ সমন্বিত হওয়ায় তা একই থাকবে চিরকাল। ফলে ১৪০১ বঙ্গাব্দ থেকে যে কোনো বছরের দিন তারিখ বার সহজে নিরূপণ করা যাবে নির্ভুলভাবে। এ ছাড়া স্মরণীয় দিনগুলো বাংলা ও গ্রেগরিয়ানে প্রতিষঙ্গী হিসেবে একই থাকবে সব সময়। যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি: ৯ই ফাল্গুন, ২৬ মার্চ: ১২ই চৈত্র, পহেলা বৈশাখ: ১৪ এপ্রিল, ১৬ ডিসেম্বর: ২রা পৌষ, ২৫ ডিসেম্বর: ১১ই পৌষ।

নতুন বাংলা পঞ্জিকা অনুসরণ করলে ধর্ম-কর্ম অনুষ্ঠান ও পূজা-পার্বণের লগ্নাদি নির্ধারণে অসুবিধা ঘটবে বলে যে অনুযোগ করা হয় তা অমূলক বলে দাবি করেছে বাংলা একাডেমি। ১৯৬৬ সালে এ সম্পর্কে তৎকালীন পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, “নতুন নিয়মে মাস গণনা করা হইল, কিন্তু তিথি-নক্ষত্রের মান পূর্বের মতো রাখা হইল। সকল সম্প্রদায়ের ধর্মকার্য প্রাচীন মত অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হইবে।… ধর্ম-কর্ম অনুষ্ঠানসূচি আমরা পূর্ববৎ রাখিলাম। মাত্র মাস গণনার হিসাব ঠিক রাখার জন্য এভাবে দিনপঞ্জি স্থির করা হইল।”

তবে এখনও নতুন ও পুরনো দু’রকম বর্ষগণনা দেখি স্থানীয় পঞ্জিকায়। মোহাম্মদী পঞ্জিকা (হামিদিয়া লাইব্রেরী লি., চকবাজার, ঢাকা)-য় উল্লেখ থাকে : বাংলা একাডেমি কর্তৃক নির্ধারিত ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বাংলা তারিখের পর বন্ধনী চিহ্নের মধ্যে পূর্ব প্রচলিত তারিখ সংযোজন করা হইল। এর উল্টো ঘটে লোকনাথ পঞ্জিকা (লোকনাথ বুক এজেন্সি, বাংলাবাজার, ঢাকা)-য়। সেখানে আগে থাকে পুরনো তারিখ, পরে ‘বাংলাদেশ’ তারিখ।

বাঙালি নানা দেশে অঞ্চলে ভাগ হয়ে থাকলেও ঐক্য বজায় রেখে চলেছে অনেক ক্ষেত্রে। বর্ষপঞ্জির ক্ষেত্রে অমন এক ঐক্য একদিন আসবে বলে অপেক্ষায় আছেন অনেকে। সেদিন নিশ্চয়ই আসবে বলে মনে করি যেদিন বিশ্ববাঙালি একই দিন পালন করবে পহেলা বৈশাখ নববর্ষ এবং অন্যান্য স্মরণীয় বরণীয় দিবস। শুভ নববর্ষ! স্বাগত ১৪২২ বঙ্গাব্দ।