জেলার কালীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রারের সহযোগিতায় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি গ্রাস করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় উপজেলাজুড়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এক খ্রিষ্টান যুবককে অপহরণ করে কমিশনে দলিল নিবন্ধনের ঘটনায় কালীগঞ্জের সাব-রেজিস্ট্রার ইসাহাক মন্ডলসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও হয়েছে। মামলার বিষয়টি জানাজানির পর গত বৃহস্পতিবার থেকে পলাতক রয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার ইসাহাক মন্ডল। সংশ্লিষ্ট দলিল লেখককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
সংখ্যালঘুদের অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে, উপজেলার নাগরি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত মঠবাড়ি গ্রামের খ্রিষ্টফার রোজারিওর ছেলে কলেজ ছাত্র প্রভাস রোজারিওকে গত ৫ অক্টোবর অপহরণ করে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুচক্র। ঘটনার সময় ওই দিন সকাল ৯টায় কলেজে যাওয়ার পথে স্থানীয় উলুখোলায় ভুলতা মহাসড়কে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করার সময় অস্ত্রের মুখে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে তাকে অপহরণ করা হয়। পরে তাকে টঙ্গী হয়ে রাজধানীর ফার্মগেট এ্লাকায় ইন্দ্রপুরী নামক আবাসিক হোটেলে নিয়ে জোরপূর্বক উপর্যপুরি মদ খাইয়ে দেয়া হয়। এর পর ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক দলিলে একাধিক স্বাক্ষর ও টিপসহি নেয় অপহরণকারীরা। পরে ওই হোটেলের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয় প্রভাসকে। কালীগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রারের প্রতিনিধি হিসেবে এক্সটা মোহরার হাফিজ হোটেলে উপস্থিত থেকে দলিলটি রেজিস্ট্রি করেন।
পর দিন অর্থাৎ ৬ অক্টোবর সকালে কৌশলে হোটেল থেকে পালিয়ে আসেন প্রভাস। তিনি অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে ফিরে এসে স্বজনদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিলে তারা ওই দিনই কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্টি অফিসে ছুটে যান। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন অপহরণকারীরা প্রভাসকে দাতা দেখিয়ে একটি আমমোক্তারনামা দলিল (নং-৭৯৭৪) রেজিস্ট্রি করেছে। এসময় স্বজনরা প্রভাসকে নিয়ে কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রারের সাথে দেখা করেন। প্রভাসের শারীরিক অবস্থা দেখে এবং ঘটনার বর্ণনা শুনে সাব-রেজিস্ট্রার ইসাহাক মন্ডল লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন। এর পর তারা সাবরেজিস্ট্রারের বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়ে বাড়ি ফিরে যান।
সাবরেজিস্ট্রার পরবর্তীতে এব্যাপারে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বরং উক্ত আমমোক্তারনামা দলিল যাতে পন্ড করতে না পারেন সেজন্য পুনরায় কমিশনে আমমোক্তারনামা দলিল সূত্রে আরো একটি বায়নানামা দলিল (নং-৮৫৭০) রেজিস্ট্রি করেন।
সাবরেজিস্ট্রারের প্রতিনিধি হিসেবে একজন নকলনবিশকে দিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের এক প্রভাবশালী নেতার উপস্থিতিতে উক্ত বায়নানামা দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়। বায়না দলিলে জমির বিক্রয় মূল্য দেখানো হয় এক কোটি ২০ লাখ টাকা। বায়না দলিলটির গ্রহিতা জনৈক মাহবুবুল আলম বলে জানা গেছে।
এদিকে নিরুপায় হয়ে প্রভাস রোজিও উক্ত আমমোক্তারনামা দলিলের প্রহিতা দীপু মিত্র ও কালীগঞ্জের সাবরেজিস্ট্রিার ইসাহাক মন্ডলসহ ৭ জনের নামে কালীগঞ্জ থানায় গত ৩১ অক্টোবর একটি মামলা নং-১৬ দায়ের করেন। মামলায় পরস্পর যোগসাজসে অপহরণপূর্বক ভয়ভীতি প্রদর্শন করে সম্পত্তি লিখে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। প্রভাস রোজারিও একই সাথে দলিলটি বাতিল চেয়ে গাজীপুরের দেওয়ানি আদালতেও পৃথক মোকদ্দমা করেন।
স্থানীয়রা জানান, প্রভাস রোজারিও বাবা-মার একমাত্র পুত্র সন্তান। প্রভাসকে দুই ফুফুর অংশ সাবকবলা দলিল মূলে রেজিস্ট্রি করে দেয়া হয়। এর পর প্রভাসের নামে ওই জমির নামজারি জমাভাগও হয়। অপহরণকারীরা প্রভাসের বাড়ির সম্পত্তিসহ প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের মোট সাড়ে ৬২ শতাংশ জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে। সংখ্যালঘু ইস্যুতে যাতে কোন জামেলায় পড়তে না হয় সেজন্য একজন হিন্দুকে আলোচিত আমমোক্তারনামা দলিলের গ্রহিতা ও খৃষ্ট্রান ধর্মের আরো একজনকে দলিলে স্বাক্ষী করা হয়েছে।
এদিকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রভাস রোজারিওকে চাপ দিচ্ছে প্রভাবশালী মহল। খ্রিষ্টফার রোজারিও জানান, প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের ভয়ে তিনি এবং ছেলে প্রভাস রোজারিও বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মামলা তুলে না নিলে সম্পত্তি দখল করে নেওয়ারও হুমকি দেয়া হচ্ছে। সম্পত্তি রক্ষায় তারা আদালতের শরণাপন্ন হলে আদালত আমমোক্তারনামা দলিলে বর্ণিত সম্পত্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন বলেও জানান তাদের আইনজীবী।
অপরদিকে একই এলাকার বড়কাউ গ্রামের সত্য রঞ্জনকে কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দাতা দেখিয়ে ৩০.৫০ শতাংশ জমির আমমোক্তারনামা দলিল নং ৮১৩০ রেজিস্ট্রি করা হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই দলিল রেজিস্ট্রির দিন সত্য রঞ্জন কালীগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসেই যাননি বলে জানন। এ ঘটনায়ও থানায় অভিযোগ দেয়া হয়েছে। নামজারি জমাভাগ (খারিজ খতিয়ান) ও দাখিলা (খাজনা পরিশোধ) ছাড়াই সাবরেজিস্ট্রার ইসাহাক মন্ডল অহরহ দলিল রেজিস্ট্রি করছেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। সংখ্যালঘুর সম্পত্তি আত্মসাতের ঘটনায় সরকারি দলের প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় আরো অনেক ভুক্তভোগী ভয়ে অভিযোগ দিচ্ছেন না বলেও জানা গেছে।
প্রভাস রোজারিও ও সত্য রঞ্জনের অভিযোগের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে কালীগঞ্জ থানার ওসি আলম চাঁন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, প্রভাস রোজারিওর ঘটনাটি অত্যন্ত নির্মম। সংশ্লিষ্ট দলিলের লেখক ইয়াসিন মিয়াকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। ইয়াসিন ঘটনার দায় স্বীকার করেছে। অন্যান্য আসামীদেরকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এদিকে এব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাবরেজিস্ট্রার ইসাহাক মন্ডলকে পাওয়া যায়নি। তিনি মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। গত বুধবার পর্যন্ত তিনি যথারীতি অফিস করেছেন বলে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের কর্মচারীরা জানান। মামলার বিষয়টি জানাজানি হলে গত বৃহস্পতিবার তিনি অফিসে যাননি।
এ ব্যাপারে গাজীপুরের জেলা রেজিস্ট্রার মো. জিয়াউল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব ঘটনা আমাকে জানানো হয়নি। সাবরেজিস্ট্রার ইসাহাক মন্ডল বৃহস্পতিবার মৌখিকভাবে আমার কাছে ছুটি চেয়েছেন।