ঢাকা, মে ৫, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১১:০৮:৩২

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

একীভূত হতে চাওয়া ব্যাংকের সম্পদের দাম যেভাবে নির্ধারণ করা হবে টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথার কারণ নেই : ওবায়দুল কাদের বিএনপি একটি রাজনৈতিক দৈত্যের দল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তি বজায় রাখার জন্য যা-যা করার আমরা করবো: বান্দরবানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবারের ঈদ যাত্রাও স্বস্তিদায়ক হচ্ছে: সেতুমন্ত্রী কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শিশুদের নতুন করে বাঁচার পথ খুলে দেয় : সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ আসন্ন পবিত্র রমজানে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির

এক ভয়ানক আতঙ্কের নাম দত্তবস্তি গ্রাম, এবং এক সংখ্যালঘু মায়ের আর্তনাদ….

| ২১ আশ্বিন ১৪২৩ | Thursday, October 6, 2016

Image may contain: 4 people

নয়ন লাল দেব, মৌলভীবাজার প্রতিনিধিঃ
ওদের জন্য আমার মানিকদের চিকিৎসা করাতে পারিনি, বাঁচতে দিল না আমার সন্তানদের, কি অপরাধ ছিল আমাদের, ঈশ্বর ঐ ভূমিখেকোদের ক্ষমা করবেন না। এভাবেই আকুল আর্তনাদ করে কান্না জড়িত স্বরে সন্তানদের হারানোর বেদনার কথা বলছিলেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখাঁন ইউনিয়নের দত্তবস্তি গ্রামের মঞ্জুরী তাঁতী নামের সংখ্যালঘু এক মা। স্বামী বিক্রম তাঁতীর (৬০) চোখে মুখেও ছিল বিষাদের ছাপ, কন্ঠ ছিল ভারী । ভিটে মাটি আর সন্তান বিয়োগের যন্ত্রনায় আজ তারা নিথর। কোন পথ নেই তাদের সামনে। সব আশা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।  ভূমিদস্যুর করাল গ্রাসে সব হারিয়ে আজ তারা নিঃস্ব। শুধু বিক্রম তাঁতীর পরিবারই নয়, ভূ-সম্পত্তি আর বসতবাড়ি হারিয়ে পথে বসেছে দত্তবস্তি গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার। জানা যায় প্রায় দুইশত বছর ধরে শ্রীমঙ্গলের লংলিয়া ছড়া দত্তবস্তি গ্রামে মৌরসী ভূ-সম্পত্তিতে বসবাস করে আসছিল এই শতাধিক পরিবার। যাদের অধিকাংশ সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের। কৃষি নির্ভর এই পরিবার গুলোর জমি চাষাবাদ আয়ের একমাত্র পথ। একসময় এই বস্তির দিকে নজর পরে স্থানীয় একটি ভুমিদস্যু কুচক্রী মহলের। জমি দখলে বিভিন্ন অপকৌশলে লিপ্ত হয় এই মহলটি। শেষমেষ গত ১১ই ডিসেম্বর ২০১৪ সালে দত্তবস্তি ঘেষা জুলেখা নগর চা বাগানের মালিক সৈয়দা গুলশানা আরা বেগমের নেতৃত্বে এক দল ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র সহ ঝাঁপিয়ে পরে অসহায় দত্তবস্তির এই শতাধিক পরিবারের উপর। এই আক্রমনের ভয়ে এদিক সেদিক পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচায় বস্তির নিরীহ লোকজন।  এরপর বাড়ি-ঘর, উপাসনালয়, ভাংচুর, ফসলাদি বিনাশ, অগ্নি সংযোগ সহ ভয়ানক তান্ডব লীলায় মেতে উঠে গুলশান আরা বাহিনী। নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় পরিবার গুলোর মাথা গোঁজার ঠাঁই ও জীবিকার উৎস। নিঃস্ব হয়ে পথে বসে এই শতাধিক পরিবার। চোঁখের সামনেই গুলশানা বাহিনীর মুঠোয় চলে যায় নিজেদের তিলে তিলে গড়ে তুলা সম্বল। সেদিনের দৃশ্য মনে পড়লে এখনও চমকে উঠেন রামনাথ কেড়োয়ার, পবিত্র কন্দ, জন্টু কন্দ, নদীয়া কন্দ, নিরঞ্জন কন্দ সহ অনেকেই। সরজমিনে তাদের সাথে আলাপ কালে আরও বলেন, গুলশান আরা বেগম আমদের সবকিছু নিয়ে নিয়েছে, ঘরবাড়ী সব জ্বালিয়ে ভষ্ম কওে দিয়েছে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো সব ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের বলতে আর কিছুই নেই। ঘটনার পর বিভিন্ন আন্দোলন, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধর্ণা দিয়েও কোন লাভ হয়নি বলেও দাবী করেন তারা। ঐ বস্তিতে খ্রিষ্টানদের এলাকায় একমাত্র গির্জাটিও ভাংচুর করে গির্জার ফাদার বীর মুক্তিযুদ্ধা জেমস্ কিরণ রোজারিও কে লাঞ্ছিত করে তারিয়ে দেয় গুলশানা আরা বাহিনী। এই করেই ক্রান্ত হননি ভূমিদস্যু গুলশান আরা। আন্দোলন ও প্রতিবাদ করায় প্রতিনিয়তই অসহায় পরিবার গুলোর উপর মিথ্যা মামলা, ভয় ভীতি প্রদর্শন এবং নিপীড়ন নেমে আসছে। বিক্রম তাঁতী মিথ্যা মামলায় জেলে থাকা অবস্থায় তার দুই সন্তান এক বৎসরের ব্যবধানে জ্যোৎ¯œা তাঁতী (২২) ও অনুকূল তাঁতী (১৬)  চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। পরিবারের দাবী সময়মতো চিকিৎসার অভাবেই মারাত্মক ব্যাধিতে মৃত্যুবরণ করে এই সন্তানগুলি। নিঃস্ব অবস্থায় অর্থের অভাবে কোন চিকিৎসা করাতে পারেননি তারা। বিক্রম তাতী কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার চোখের সামনে দুই সন্তানকে হারালাম, এবারের পূজাতে ওরা আর আমার কাছে বায়না ধরবে না। এই বলে বাক রুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। এখনও ফাদার তার ভঙ্গ গীর্জার মাটিতে বসে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করার সময় শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন। নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি এই ধর্ম যাজক। ভূমি দখলদারীদের বিরুদ্ধে কথা বলায় জেল কাটানো হয়েছে ফাদারকে। বীর মুক্তি যোদ্ধা ফাদার রোজারীও জানান, এই ঘটনার পর প্রসাশনের কাছে গিয়েছি, বিভিন্ন মহলের দারস্থ হয়েছি, তারা উল্টো আপোষ করার পরামর্শ দিয়েছেন, আমি মুক্তি যোদ্ধা, একজন নিরীহ ধর্ম যাজক, এই দিনটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। আজ ভূমি দস্যু গুলশান আরা বাহিনীর  বিরুদ্ধে অসহায় পরিবার গুলোর প্রতিবাদ করার কোন ভাষা নেই, নেই তাদের কোন শক্তি। শুধু কান্নাকাটি আর অরেণ্যে রোদন ছাড়া আপাতত রক্ত ঝড়া মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তির যেমন উপায় নেই, তেমনি মাথা গুজার ঠাঁই নেই। আদালতে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে দেওয়ানী মামলা হলেও সরকার বা আসামীপক্ষ কোন জবাবই দিচ্ছে না বলে জানান বাদী পক্ষের আইনজীবি। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সহ ২৩টি সংগঠন সরজমিন তদন্ত করে বিষয়টির সত্যতা প্রাপ্তি হলেও শ্রীমঙ্গলের ভার প্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না এবং বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে কৌশলে এড়িয়ে যান। শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ শহীদুল হক জানান, ওই ঘটনার সময় তিনি এখানে দ্বায়িত্বরত ছিলেন না এবং দ্বায়িত্ব নেওয়ার প্রায় এক বছর হয়ে গেলেও উক্ত ঘটনার বিষয় অবহিত হননি বলেও মন্তব্য করেন। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসন, জেলা পরিষদ, ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে একাধিক বার যোগাযোগ করেও কোন সুরাহা পাননি বলে দাবী করেন বস্তিবাসীরা। এছাড়া, ফাদার রোজারিও বিগত ৯ই এপ্রিল ২০১৫ইং তারিখে শ্রীমঙ্গল মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেন বলেও জানা যায়। এরপরও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দ্বায়সারা  মনোভাবে উদ্ভিগ্ন বস্তিবাসী। ঘটনার এতদিন পরেও প্রশাসনিক নিষ্কৃয়তায় এলাকায় সৃষ্টি করেছে ধু¤্রজাল।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন মৌলভীবাজার জেলা শাখার সভাপতি এডভোকেট কিশোরী পদ দেব শ্যামল বলেন, দত্তবস্তির নিরীহ নির্যাতিত সংখ্যালঘু হিন্দুরা খুব কষ্টে জীবনযাপন করছে। তারা ভূমি খেকো গুলশান আরা বেগমের ভয়ে দিশে হারা। অভিলম্বে দত্তবস্তির নির্যাতিতদের যদি সাহায্য করা না হয় তা হলে দত্তবস্তির নির্যাতিতরা নিশ্চিত মৃত্যুবরণ করবে। তারা এখন মানববেতর জীবন যাপন করছে। আমরা সরজমিনে গিয়ে ঘটনা তদন্ত করে সত্যতা নিরুপণ করেছি।  পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ না করাটা সত্যিই পীড়াদায়ক। এখন বৃক্ষ লতার নীচে বসে ক্ষুধার্থ নিপীড়িত মানুষগুলো ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
এছাড়া পাহাড় রক্ষা উন্নয়ণ সোসাইটির সভাপতি সালাউদ্দিন আহমদ জানান, উক্ত ঘটনায় একটা সম্মিলিত শক্তি ষড়যন্ত্র করছে, এই নির্যাতিতদের পক্ষে কাজ করায় উনাকেও বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।  তবে যে কোন পরিস্থিতে এই অসহায় মানুষদের পক্ষে যে কোন আন্দোলনে নামার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এদিকে ছন্নছাড়া উদ্ভাস্ত জীবনযাপনকারী এই শতাধিত পরিবারের স্কুল কলেজ পড়–য়া অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আর্থিক অনটন আর বিপন্ন জীবন তিলে তিলে ধংশ করে দিচ্ছে অকালে ঝরে পরা এই স্বপ্নগুলো।
এ বিষয়ে শ্রীমঙ্গল দ্বারিকা পাল মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপিকা ও পাহাড় রক্ষা উন্নয়ন সোসাইটির নেত্রী সুচিত্রা ধর দুঃখের সাথে জানান,  এটা খুব বর্বর একটা ঘটনা, বর্তমান সভ্য আধুনিক যুগে এসেও আমরা এই ধরনের দৃশ্য দেখব ভাবা যায় না। তাছাড়া সমাজ ও প্রশাসনের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই ধরনের অপকর্ম মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানায়। আজ দত্ত বস্তির নিরাশ্রয় পরিবার গুলোর অবস্থা শোচনীয়, চিকিৎসা, খাদ্যাভাবে সন্তানদের মৃত্যু দেখতে হচ্ছে মা-বাবার, এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কি হতে পাওে !!! ছাত্র-ছাত্রীদের লেখা-পড়া বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের আশা, আকাঙ্খা, স্বপ্ন সব আজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সকল শিক্ষানুরাগী, মানবতাবাদী, সমাজকর্মী সহ সবাইকে এই অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহব্বান জানান তিনি।
সর্বোপরি স্বাধীনতার এত বছর পরেও শ্রীমঙ্গলে দত্ত বস্তির বিপন্ন ও প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে পাঞ্জা লড়ে যাওয়া এই সংখ্যালঘুদের আর্তি গগনস্পর্শি। ভূমি খেকো কেড়ে নিয়েছে সব। দুই বছর ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই, ভয়-ভীতি আর হুমকিতে দিশেহারা এই (দত্তবস্তি) শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবার। প্রশাসনের নিরব ভূমিকা, নাটকীয়তায় প্রশ্ন জাগে শেষ রক্ষা হবে কি তাদের?  প্রতিটা মুহুর্ত উদ্ভিগ্ন, উৎকন্ঠা ও আতংকে থাকা অসহায় এই দত্তবস্তির সংখ্যালঘুদের আজ বুক ফাটা একটাই আর্তি, তারা বাঁচতে চায়, মাথা গুজার ঠাঁই চায়, শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে চায়, স্বাধীনতা চায়। দত্ত বস্তির আকাশে - বাতাসে ভেসে বেড়ায় ওদের কান্না আর আকুল আর্তি। এটা কি পৌঁছাবে সংশ্লিষ্ট সচেতন মহলে….?