নিউজ ডেস্ক: অস্ত্রধারী যুবকদের উন্মত্ত নৃশংসতা দেখে একবারের জন্যও তারা ভাবেননি যে, প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেন সেখান থেকে। শুক্রবারের সেই ভয়ঙ্কর রাতে গুলশানের কূটনৈতিকপাড়ার স্প্যানিশ ক্যাফে হলি আর্টিসান ও কিচেনে যা ঘটেছে, তা এখনও সুস্থিরভাবে বলা সম্ভব নয় উদ্ধার জিম্মিদের পক্ষে। কেননা তাদের অনেকেই চোখের সামনে দেখেছেন, কী নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে বিদেশি নাগরিকদের।
বিভীষিকাময় সেই রাতটির কথা তারা বলছেন বটে, কিন্তু বারবার শিহরিত হচ্ছেন। কথা বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছেন। উদ্ধার হওয়া প্রায় সবার সঙ্গেই এর মধ্যে কথা বলেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কর্মকর্তারা।
তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে রাতভর জঙ্গি সদস্যদের কার্যক্রম সম্পর্কে নানা তথ্য। অনেক প্রশ্নের উত্তরও মিলেছে তাতে। মানসিকভাবে সুস্থির হতে আরও সময় লাগবে উদ্ধার জিম্মিদের। কিন্তু তাদের দেওয়া সে রাতের নানা তথ্যগুলো সাজালে স্পষ্টই বোঝা যায়, এমন আতঙ্ক ও বিভীষিকাময় রাত শুধু তাদের জীবনে নয়, বাংলাদেশেও নেই বললেই চলে।
গত শুক্রবার আনুমানিক রাত পৌনে ৯টার দিকে সশস্ত্র জঙ্গি দলটি ক্যাফের লনে ঢুকেই গুলি ছুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয় বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ক্যাফের অপ্রস্তুত নিরাপত্তাকর্মীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই অস্ত্রধারীরা ভেতরে ঢুকে পড়ে। রাতভর চলে তাদের নৃশংসতা।
মূল টার্গেট ছিল বিদেশি
শনিবারের কমান্ডো অভিযানে হলি আর্টিসানের একটি টয়লেট থেকে উদ্ধার করা হয় অন্তত আটজনকে। তাদের একজন ক্যাফের কর্মী রিন্টু কীর্তনিয়া।
সে রাতের বিভীষিকার কথা বলতে গিয়ে রিন্টু বলেন, ‘ভেতরে ঢুকেই গুলি করতে থাকে সন্ত্রাসীরা। কিছুক্ষণ পর গুলি করা থামিয়ে ওরা বেছে বেছে বিদেশিদের আলাদা করতে থাকে। আমাদের স্থান হয় টয়লেটে।’ তিনি জানান, টয়লেটে রাখার আগে জঙ্গিরা তাদের হত্যা না করার আশ্বাস দেয়। তবে বিদেশিদের হোটেলের হলরুমে জিম্মির পর পরই তারা গুলির শব্দ পান।
উদ্ধার হওয়া ক্যাফের অপর কর্মী রাকিব বলেন, ‘ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্রের সঙ্গে ছুরি-চাপাতিও ছিল। ওরা বলছিল, তোদের মারব না। শুধু আমরা যা বলি, তোরা তাই করবি। আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল বিদেশিরাই জঙ্গিদের টার্গেট। বিদেশিদের খুঁজছিল ওরা।’
আধাঘণ্টার মধ্যেই হত্যা
জিম্মি কয়েকজন উদ্ধারের পর গতকাল রোববার মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে শুক্রবার রাতে ক্যাফের ভেতর বিদেশিদের হত্যার বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। কয়েকজন জানিয়েছেন, ক্যাফেতে ঢোকার প্রথম আধাঘণ্টার মধ্যেই বিদেশিদের হত্যা করে জঙ্গিরা। প্রথমে তাদের গুলি করা হয়। টার্গেট করে কাছ থেকে গুলি করে ওরা। এরপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা নিশ্চিত করে।
কয়েকজনের লাশ একসঙ্গে রাখা হয়। কিন্তু পরে তা আর একত্রিত করা হয়নি। হত্যার পর রাতভর তাদের বাইরের দিকে অস্ত্র তাক করে থাকতে দেখা যায়। তবে খুব বেশি সময় ধরে বসে থাকতেও দেখা যায়নি তাদের। প্রায়ই তারা পায়চারি করছিল। অস্ত্রধারীদের কেউ কেউ ছবিও তুলছিল।
ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার হওয়া অনেকের সামনেই জঙ্গিরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। তবে জঙ্গি দলের কোনো কোনো সদস্য বাংলাদেশের নাগরিকদের আশ্বস্ত করে বলে, তাদের (বাংলাদেশিদের) মারা হবে না। জিম্মি কয়েক শিশু ও নারীকেও একইভাবে আশ্বস্ত করা হয়েছিল।
রাতভর ধর্মীয় বই পড়ে জঙ্গিরা
উদ্ধার হওয়া লোকজন পুলিশকে জানান, আটক করার পর জঙ্গিরা জিম্মিদের ধর্মীয় পরিচয় জেনে নেয়। অনেককে তারা কলেমা-সূরা পাঠ করতে বলে। যারা তা পারেন, তাদের আলাদা করা হয়, চলে যাওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়। তবে অনেকেরই আতঙ্কে হেঁটে বের হওয়ার অবস্থা ছিল না। কেননা মনে হচ্ছিল, হাঁটলেই জঙ্গিরা গুলি চালাবে।
হলি আর্টিসানের হলরুম থেকে উদ্ধার হওয়া একজন বিদেশি চিকিৎসক পুলিশকে জানান, হত্যাকাণ্ডের পর জঙ্গিদের কয়েকজনকে তিনি রাতভর বিভিন্ন ধর্মীয় বই পড়তে দেখেছেন। জিম্মি দু-একজনকেও ইংরেজি ভার্সনের কোরআন পড়তে দেওয়া হয়। কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকে জঙ্গি সদস্যরাও।
যেভাবে বাঁচলেন বিদেশি চিকিৎসক
ভারতীয় চিকিৎসক ডা. সত্য প্রকাশ। হামলার সময় তিনি ক্যাফেতে ছিলেন। রাতভর দেখেছেন জঙ্গিদের তাণ্ডবলীলা। গোয়েন্দারা ওই চিকিৎসকের সঙ্গেও কথা বলেছেন। ওই সময় তিনি বিদেশি হওয়ার পরও কীভাবে বেঁচে গেলেন, তার বিবরণ দেন। ডিবি পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ওই চিকিৎসকের ও তার দেশের নাম জানালেও অন্য কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি।
পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ডা. সত্য প্রকাশ নানা তথ্য দিয়ে বলেছেন, অস্ত্রধারীদের টার্গেট ছিল বিদেশিরা। বেছে বেছে বিদেশিদের হত্যা করে মোবাইল ফোনে ছবি তোলা হচ্ছিল। অস্ত্রধারী সবাই বাংলায় কথা বললেও তারা ইংরেজি জানত। বাংলাভাষীদের ওরা মারছিল না। ওই সময় তিনি নিজেও বাংলায় কথা বলতে শুরু করেন। একজন জঙ্গি তাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই নিজেকে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় দিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এতে ওই জঙ্গি তাকে আর বেশি কিছু জেরা করেননি।
ওই চিকিৎসক জানান, নিজের প্রাণ নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। এই বুঝি বন্দুকটা তার দিকে তাক করা হচ্ছে! পাশাপাশি একজন চিকিৎসক হিসেবে চোখের সামনে এত ক্যাজুয়ালিটি (আহত) দেখে সেবা দিতে না পারার যন্ত্রণায়ও ভুগছিলেন তিনি।
বারবারই তারা ফোনে কিছু লিখছিল
উদ্ধার হওয়া ক্যাফে কর্মী বাচ্চু পাটোয়ারী জানান, জিম্মি হওয়ার আধাঘণ্টার মধ্যেই তিনি ও তার শেফ আর্জেন্টিনার নাগরিক দিয়াগো ছাদ থেকে লাফিয়ে পালান। তারা বের হওয়ার আগেই সবাইকে হত্যা করা হয়। তারা লাফিয়ে পাশের একটি বাড়ির সীমানা প্রাচীরের কাছে পড়েন। তবে সবকিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন। অস্ত্রধারীরা বারবার ফোন কানে নিচ্ছিল, আবার কিছু একটা লিখছিল। জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার হওয়া সমীর রায়ও প্রায় একই তথ্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাদের টয়লেটে আটকে রাখলেও একবার দরোজাটা খুলে দেওয়া হয়। ওই সময় দেখেন এক অস্ত্রধারী মোবাইল ফোনে কথা বলছেন। তিনি কোন ভাষায় কথা বলছেন, গুলির শব্দে তা বোঝা যাচ্ছিল না।
ডিবি পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ২৭ জনের কাছ থেকে ডিবি পুলিশ তথ্য নিয়েছে। তাদের প্রায় সবাইকে স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাদের কাছ থেকে মূলত ওই রাতের বিবরণ নেওয়া হচ্ছে।
তথ্যসূত্র- সমকাল