ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আলবদর ও জামায়েত নেতা মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদনের ওপর আজ শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী ৩০ আগস্ট মঙ্গলবার রায় দেয়া হবে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে আজ আসামী ও রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি শেষে রায় দেয়ার এই দিন ধার্য করা হয়।
আজ রোববার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুই দফায় প্রায় দুই ঘণ্টা রিভিউ বিষয়ে শুনানি হয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
গত ২৪ আগস্ট আসামীপক্ষে সময় আবেদন নাকচ করে দিয়ে মীর কাসেম আলীর আইনজীবীকে ওই দিন শুনানি শুরুর নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। এরপরই মীর কাসেমের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানি শুরু করেন। আজ দ্বিতীয় দিনে বিষয়টির ওপর শুনানি শেষ হয়।
যে অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডাদেশ হয়েছে তা সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়নি দাবী করে রায় রিভিউ’র আবেদন পেশ করেন আসামী পক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। অপরদিকে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আসামী মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি পেশ করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে আল-বদর নেতা মীর কাসেম আলী চট্টগ্রামে টর্চার সেল ডালিম হোটেলের মূল হোতা ছিলেন উল্লেখ করে মুক্তিযোদ্ধা কিশোর জসিম হত্যায় এ আসামীর সমপৃক্ততা বিষয়ে দেয়া সাক্ষিদের সাক্ষ্য তুলে ধরেন। এটর্নি জেনারেল আসামীপক্ষে আনা রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় বহাল রাখতে আর্জি পেশ করেন।
যে অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড: অভিযোগ ১১: মুক্তিযুদ্ধকালে ঈদুল ফিতরের পরে একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে শহরের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যুবরণ করলে আরো পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তার মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে মীর কাসেমের ফাঁসির রায় দেয়। আপিলেও তা বহাল থাকে। এছাড়া আরও ছয় অভিযোগে মোট ৫৮ বছরের কারাদন্ডের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। এর আগেও ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে দন্ডিতদের মধ্যে আপিলের রায়ের পর মীর কাসেমের আগে রিভিউ করেছিলো সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মো. মুজাহিদ, মো. কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লা। শুনানি শেষে তাদের রিভিউ আবেদন খারিজ করে রায় দেয় আপিল বিভাগ। রিভিউ খারিজের পর তাদের সবার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়।
এ মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশন মীর কাসেমকে আখ্যায়িত করেছে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হওয়া ‘বাঙালি খান’ হিসাবে, যিনি সে সময় জামায়াতের তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আল বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন মীর কাসেম। কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা এ মামলার রায়ে উল্লেখ রয়েছে। মীর কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেয়া হয়েছিল ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় আল বদর বাহিনীর চট্রগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির ও টর্চার সেল।
গত ১৯ জুন আপিল বিভাগের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন মীর কাসেম আলী। ওই আবেদনে ১৪টি আইনগত যুক্তি তুলে ধরে তাকে বেকসুর খালাস দেয়ার আবেদন জানানো হয়।
জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে দেয়া আপিল বিভাগের পূর্নাঙ্গ রায় গত ৬ জুন প্রকাশ করা হয়। মীর কাসেম আলীর আপিল মামলায় রায় প্রদানকারী প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রায়ে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশিত হলো। অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। এটি আপিলে সপ্তম মামলা যার চূড়ান্ত রায় হলো।
নিয়ম অনুযায়ী আপিল বিভাগ থেকে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ডের পূর্ণাঙ্গ রায় মামলাটির বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। এর ভিত্তিতে মীর কাসেম আলীর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে এ পূর্ণাঙ্গ রায় কারাগারসহ সংশ্লিস্ট জায়গায় পাঠায় ট্রাইব্যুনাল। কারাগারে মীর কাসেম আলীকে মৃত্যু পরোয়ানা ও রায় পড়ে শোনানো হয়। রায় অবগত হওয়ার পর রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন জানানোর জন্য ১৫ দিন সময় রয়েছে। সে অনুযায়ি মীর কাসেম আলী রিভিউ করেছেন।
গত ৮ মার্চ মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত রায় রায় ঘোষণা করেছিলো আপিল বিভাগ। গত ৬ জুন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এর আগে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মীর কাশেম আলীকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের আদেশে ২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাশেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। সে থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।