ঢাকা, এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১০:৪২:১৬

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র পুনর্বাসন না করে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা হবে না: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি হিসেবে ফের নিয়োগ পেলেন বিপ্লব বড়ুয়া সংসদ অধিবেশন উপলক্ষে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ আপিলে দ্বিতীয় দিনে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ৫১ জন নির্বাচনে ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনী চায় ইসি : পিএসও আদালত আবমাননায় বিচারক সোহেল রানার সাজার বিরুদ্ধে আপিলের রায় ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর ২১টি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৪ জন গ্রেফতার : ডিএমপি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কিনা, জানালেন ইসি

আমলাদের প্যাঁচে অশেষ যন্ত্রণায় অর্পিত সম্পত্তি

| ২২ বৈশাখ ১৪২২ | Tuesday, May 5, 2015

নারায়ণগঞ্জের একটি প্লটে ১৬৭ শতাংশ জমি। জমিটি অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হওয়ায় মালিক অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন এবং নিজের পক্ষে রায় পান। এরপর সরকার আপিল করে। আপিলেও মালিককে জমি ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ আসে। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন অনুযায়ী এ জমির মালিকানা ফিরে পেতে জমির মালিকের আর কোনো বাধা থাকার কথা নয়; কিন্তু তার পরও নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকসহ (ডিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জমির মালিকের নামে কাগজপত্র করে দিচ্ছেন না।

নারায়ণগঞ্জের ডিসি আনিসুর রহমান মিঞার কাছে জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল ও আপিলের রায়ের পরও মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সমন্বিত নীতিমালা থাকলে ভালো হয়। কারণ একেক জেলায় একেক ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। এসব সমস্যার বিষয়ে যদি মন্ত্রণালয়ের আলাদা নির্দেশনার প্রয়োজন হয়, তাহলে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। আমরা ভূমি মন্ত্রণালয়কে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের অনুরোধ করেছি।’

অর্পিত সম্পত্তির ওপর মালিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার পরও ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জমির মালিকের নামে নামজারি করে দিতে ভয় পাচ্ছেন। তাঁদের ভয় ভবিষ্যতে অজানা বিপদে পড়ার। এ কারণে কোনো কর্মকর্তাই দায়িত্ব নিচ্ছেন না। তাঁরা একে অপরের কাঁধে দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছেন। এসিল্যান্ড ডিসির নির্দেশনা চান। ডিসি ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চেয়েছেন। অথচ আইন অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল ও আপিলের রায় পাওয়া গেলে জমির মালিকের নামে খারিজপত্র জারি করায় আর কোনো বাধা নেই। তার পরও নিজে ‘বিপদমুক্ত’ থাকার জন্য ডিসি ভূমি মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়েছেন।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের আমলারাও বিষয়টি নিয়ে প্যাঁচ কষছেন। গত ১২ মার্চ ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। মন্ত্রণালয়ের চার লাইনের ছোট সেই নির্দেশনায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। নির্দেশনায় ‘কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত না হলে এবং এর মাধ্যমে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারের কোনো ক্ষতি সাধিত না হলে’ আদালতের রায় বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না- এই নিশ্চয়তা তাঁরা কিভাবে দেবেন? আদালতের রায়ের পরও কেন মন্ত্রণালয় থেকে এ ধরনের মতামত দেওয়া হলো, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন কর্মকর্তারা। ‘সরকারের কোনো ক্ষতি সাধিত না হলে’ এই ছয়টি শব্দ দিয়ে ভবিষ্যতে কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন। বিশেষ করে ক্ষমতার পালাবদল হলে তো কথাই নেই। জেলা প্রশাসনের উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘ক্ষমতার পালাবদলের কথা বাদই দিলাম, বর্তমান সরকারও যে এই ছয়টি শব্দ দিয়ে কর্মকর্তাদের ঝামেলায় ফেলবে না তার নিশ্চয়তা কী?’ এই অবস্থায় ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে স্পষ্ট করে বলতে হবে, আদালতের রায় বাস্তবায়ন করা হোক। তা না হলে মালিকের নামে নামজারি করার স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত কোনো কর্মকর্তা নেবেন না।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, এই চিত্র সারা দেশেরই। সব জেলায়ই ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। সেখান থেকে যে রায় হচ্ছে তা ভূমির মালিকের পক্ষে গেলেই সমস্যা। কারণ তাঁকে নামজারি করে দিতে হবে। কোনো ডিসি বা অন্য কর্মকর্তারা নামজারি করে দিচ্ছেন না। সবাই জুজুর ভয় পাচ্ছেন।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শফিউল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ট্রাইব্যুনালের রায় ও আপিলের রায় ভূমির মালিকের পক্ষে গেলে সেই জমি অবশ্যই জমির মালিকের নামে নামজারি করে দেওয়া হবে। এখানে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার দরকার নাই। আর যদি কেউ নির্দেশনা চেয়েও থাকেন, তাহলে তাঁকে হস্তান্তরের নির্দেশনাই দিতে হবে।’

বুকের কষ্ট চাপা দিয়ে, চোখের জলে ভেসে সহায় সম্পত্তি ফেলে শুধু প্রাণটুকু সম্বল করে যাঁরা দেশ ছেড়েছিলেন, তাঁদের উত্তরাধীকারের কাছে সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের এ প্রগতিশীল ভাবনার যোগ্য সঙ্গী হতে বা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি প্রশাসন। তাদের গড়িমসিতে সময়ভিত্তিক এ কর্মসূচিটাই পণ্ড হওয়ার মুখে। সরকার যেখানে সমস্যার সমাধান চাচ্ছে, প্রশাসন সেই সমস্যা জিইয়ে রাখতে চাচ্ছে। এর কৌশল হিসেবে বারবার আইনটি সংশোধন করার জন্য মন্ত্রিসভায় তোলা হচ্ছে। তিন বছরের মধ্যে পাঁচ দফা আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। এই অবস্থায় গত ১০ নভেম্বর মন্ত্রিসভায় নেওয়া হয় ষষ্ঠ সংশোধনীর জন্য। কিন্তু বারবার আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব করায় মন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা আইন সংশোধন না করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে ফেরত পাঠান। এরপর সমস্যা আরো বেড়েছে। কারণ বিভিন্ন জেলা থেকে এখনো ‘ক’ তফসিলের সম্পত্তি বের হচ্ছে। এগুলো গেজেটভুক্ত না করলে সামনের দিনগুলোতে বেহাত হয়ে যাবে। এই অবস্থায় ভূমি মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

ভূমি সচিব বলেন, সংশোধন করার প্রস্তাব নিয়ে আইনটি আবারও মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। এবার ভিন্ন ফরমেটে তোলা হবে। আগেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়া হবে। কারণ আইনটির সংশোধনী প্রয়োজন।

মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি মালিক বা তাঁদের উত্তরাধীকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন প্রণয়ন করা হয়। ক্ষমতার পালাবদল হলে আইনটি অকার্যকর করে রাখে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। ফের ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অর্পিত সম্পত্তির সমস্যাগুলো মিটিয়ে ফেলার জন্য আইনটিতে বড় ধরনের সংশোধনী করে আওয়ামী লীগ সরকার। সেই সংশোধনীতে ১২০ দিনের মধ্যে সরকারের দখলে থাকা অর্পিত সম্পত্তি সঠিক মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কর্মসূচি নেওয়া হয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তালিকা তৈরির কাজই করতে পারেনি প্রশাসন। এরপর সমস্যাগুলো দীর্ঘায়িত করে ২০১২ সালে দুই দফা ও ২০১৩ সালে আরো দুই দফা সংশোধনী আনা হয়। প্রতিবারই সময় নির্ধারণ করে দিয়ে তার মধ্যে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়। কিন্তু কোনোবারই সমস্যার সমাধান করা হয়নি। এই অবস্থায় আবার আইনটির সংশোধনীর খসড়া তৈরি করা হচ্ছে।

সরকার ২০১১ সালে যখন আইনটি সংশোধন করে তখন ‘ক’ ও ‘খ’ তফসিলের বিধান ছিল। যেসব সম্পত্তি সরকারের দখলে ছিল তা ছিল ‘ক’ তফসিলভুক্ত। আর যেসব সম্পত্তি সরকারের দখলে ছিল না, সেগুলো ছিল ‘খ’ তফসিলে। কিন্তু ২০১৩ সালে এসে ‘খ’ তফসিল বাদ দেওয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত সংসদে পাস হওয়ার পরও তা বাস্তবায়নে গড়িমসি করা হয়।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ‘ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুলস, ১৯৬৫’ অনুসারে ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যেসব নাগরিক পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারতে চলে যান, তাঁদের রেখে যাওয়া সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে শত্রু সম্পত্তির নাম রাখা হয় অর্পিত সম্পত্তি। সেসব সম্পত্তি বৈধ উত্তরাধিকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যপর্ণ আইন করা হয় ২০০১ সালে। সেই আইনটিই দফায় দফায় সংশোধন করা হচ্ছে।

ট্রাইব্যুনাল ও আপিলের রায়ে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত জমি ফিরে পাওয়া মানিকগঞ্জ জেলার এক ভুক্তভোগী কালের কণ্ঠকে জানান, সব রায় আমার পক্ষে। এর পরও কর্মকর্তারা নামজারি করে দিচ্ছেন না। তাঁরা বলছেন, ‘এ জমির নামজারি করলে তাঁরা ভবিষ্যতে বিপদে পড়বেন। এ কারণে নিজেরা দায়িত্ব দিচ্ছেন না। আর কত দিন এ যন্ত্রণা বহন করব বলতে পারেন? ৪০ বছর ধরে এ ভার বইছি। কে বা কারা আমার সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করেছে আমি তা জানি না। এ নিয়ে আমি ৪০ বছর ধরে লড়াই করছি।’ নতুন কোনো হয়রানির ভয়ে মানিকগঞ্জের এ ভুক্তভোগী নিজের নাম-ঠিকানা প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।সূত্র-কালেরকন্ঠ