ঢাকা, এপ্রিল ২৯, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১৬:১৯:৩৪

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

একীভূত হতে চাওয়া ব্যাংকের সম্পদের দাম যেভাবে নির্ধারণ করা হবে টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে বিএনপির মাথাব্যথার কারণ নেই : ওবায়দুল কাদের বিএনপি একটি রাজনৈতিক দৈত্যের দল : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তি বজায় রাখার জন্য যা-যা করার আমরা করবো: বান্দরবানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবারের ঈদ যাত্রাও স্বস্তিদায়ক হচ্ছে: সেতুমন্ত্রী কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শিশুদের নতুন করে বাঁচার পথ খুলে দেয় : সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ আসন্ন পবিত্র রমজানে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির

অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে ঘুষেই গেছে ২ হাজার ২৭০ কোটি

| ৩১ বৈশাখ ১৪২৪ | Sunday, May 14, 2017

ছবি: প্রথম আলো

অর্পিত সম্পত্তি ফিরে পেতে একজন ভুক্তভোগীকে গড়ে প্রতি মামলায় ২ লাখ ২৭ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয় হয়েছে ঘুষ দিতে। সম্পত্তি ফিরে পেতে এ যাবৎ ২ লাখ আবেদনকারীকে ঘুষ দিতে হয়েছে কমপক্ষে ২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা।

‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের ফলাফল এবং এর বাস্তবায়নের প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, এ হিসাব অমূলক, তা বলা যাবে না। তবে ঘুষের পরিমাণ বেশি বলে মনে হয়েছে।
অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে দেশের প্রথম গবেষণা করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত এ গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন। অর্পিত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেওয়ার মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে এ ধরনের গবেষণা এই প্রথম। ভূমি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) সহযোগিতায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়। কাল রোববার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে এ গবেষণাটি তুলে ধরা হবে।
ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ‘ক’ ও ‘খ’ তালিকা মিলিয়ে দেশে অর্পিত সম্পত্তির মোট পরিমাণ ৯ লাখ ৬২ হাজার ৬১২ একর। সরকার ‘খ’ তফসিল বাতিল করার ফলে এখন ‘ক’ তালিকাভুক্ত প্রত্যর্পণ বা ফেরতযোগ্য অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার ১৯১ একর।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে সম্পত্তি ফেরত পেতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। বাস্তবে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের পরিস্থিতি দেখতেই এ গবেষণা করা হয়।
অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ বেশি আছে, দেশের এমন সাতটি জেলায় এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। অর্পিত সম্পত্তির মামলার ৪৩টি ঘটনার বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান, ৪৬ জন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাৎকার এবং নথি বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ গবেষণা হয়। গবেষণা চলে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত।
গবেষণায় দেখা গেছে ১ থেকে ৫০ শতাংশ জমির মালিকদের গড়ে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬ টাকা। ৫১ থেকে ১০০ শতাংশ জমির মালিকের খরচ ১ লাখ ৩১ হাজার টাকা। আর ১০০ শতকের বেশি জমির মালিকের গড় ব্যয় ১ লাখ ৭৫ হাজার ২৫০ টাকা।
গবেষণায় বলা হয়েছে, আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার আগে থেকেই ঘুষ পর্ব শুরু হয়। তহশিলদার, উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় থেকে নথি তোলার সময়ই বেশি পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হয়। এরপর আদালতে দীর্ঘ সময় ধরে মামলা ঝুলে থাকে। সে সময় আইনজীবীদের ফি বাবদ ব্যয়, যাতায়াত ইত্যাদি নানা খরচ করতে হয় সম্পত্তি ফেরত চাওয়া ভুক্তভোগীদের।
আবুল বারকাত বলেন, ‘আমরা যে অর্থ ব্যয় এবং ঘুষের চিত্র পেয়েছি, বাস্তবে এর চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে মানুষের। কারণ, একটি মামলাকে ঘিরে অনিশ্চয়তা, সময় ব্যয়, নিগ্রহ-এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে এর আর্থিক দাম ১০ গুণ বেশি হবে।’
ভুক্তভোগীরা চারটি শ্রেণিকে বিচারের রায়ের দীর্ঘসূত্রতার জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করেন। সেগুলো হলো ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়, এসি ল্যান্ডের কার্যালয়, আইনজীবী ও সরকারি কৌঁসুলি।
গবেষণার জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশই বলেছেন, সম্পত্তি ফিরে পেতে তারা ধারাবাহিক মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন। অকারণ ব্যয়, ঋণ করা, সঞ্চয় কমে যাওয়ার ফলে এই মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হয় তাঁদের।
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় শত্রু সম্পত্তি আইন করা হয়। এর মাধ্যমে দেশের সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তিই শত্রু সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। আইনটির ফলে এসব মানুষ তাঁদের সম্পত্তিতে মালিকানা হারান। সম্পত্তির খাজনা আদায় বন্ধ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শত্রু সম্পত্তি আইনের নাম পাল্টে অর্পিত সম্পত্তি হয় বটে, তবে আইনটি বাতিল হয়নি। ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন হয়। তবে পরে আইনটি কার্যকরের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০১১ সালে নতুন করে সম্পত্তি ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। এর মধ্যে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ছয় দফা সংশোধনী আনা হয়।
‘ক’ তালিকার সম্পত্তি ফেরত পেতে আবেদনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১২ সাল থেকে। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার ৭০০টি মামলার রায় হয়েছে। তবে এসব মামলাও আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ের অপেক্ষায় রয়ে গেছে। মামলা ফেরত পেতে দীর্ঘসূত্রতা, অনিয়মের অভিযোগ করে আসছে এ ভূমি অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অসৎ কর্মচারী-কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, আইন মন্ত্রণালয়ের অনীহার কারণেই ৫০ বছরের একটি অন্যায় চলছেই। পদে পদে অকারণ অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে ভুক্তভোগীদের। এ সম্পত্তি যেন লুটের বস্তু। তাই যে যার মতো করে পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে।
ভূমি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণে দায়িত্বপ্রাপ্ত যারা, তারা সঠিকভাবে তাদের কাজ করছে না, এটা ঠিক। তবে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান ভূমি ব্যবস্থাপনার রাজনৈতিক-অর্থনীতি নিয়ে গবেষণার কাজ করেছেন। এই গবেষণা নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভূমির যন্ত্রণা সর্বজনীন। তবে সংখ্যালঘুদের মতো ক্ষমতার বলয়ে যাঁরা থাকেন না, তাঁদের জন্য এ সমস্যাটি আরও প্রবল। এ গবেষণার উপাত্তগুলো সেই বাস্তবতার প্রতিফলন।
‘ক’ তালিকাভুক্ত সম্পত্তি ফেরত পেতে চেষ্টা করছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এমন ভুক্তভোগী দুজনের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলো। তাঁদের কেউই নিজেদের পরিচয় দেননি এ জন্য যে তাঁদের মামলা এখনো চলছে। তাঁদের একজন বগুড়ার শেরপুরের বাসিন্দা এক ব্যবসায়ী। ‘ক’ তালিকায় থাকা সাড়ে তিন বিঘা জমি এবং শহরে থাকা দুই শতক জায়গা ফেরত পেতে দুটি আবেদন করেন তিনি। তাঁর বাবার এই দুটি জায়গা অর্পিত তালিকাভুক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে দুটি আবেদনেই আদালতের রায় গেছে তাঁর পক্ষে। জমির মামলায় আবেদন করেছিলেন ২০১২ সালে। রায় পেয়েছেন ২০১৫ সালে। কিন্তু এখন সরকার আপিল করায় মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। শহরের জায়গার জন্য ২০১৩ সালের আবেদনে রায় পেয়েছেন গত বছর। শেরপুর শহর থেকে বগুড়ার দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা দুঃসহ। এক দফা অর্থ গেছে ভূমি অফিসে। এরপর বছরে অন্তত ২৪ বার শুনানির তারিখ পড়েছে। ফাইল যেন ওঠে, এ জন্য আগের দিন গিয়ে আদালতে ধরনা দিতে হয়েছে সেরেস্তাদারের কাছে। সে জন্য সেরেস্তাদার ও পেশকারকে দিতে হয়েছে টাকা। ব্যবসায়ীর কথা, নিজের নিযুক্ত করা আইনজীবী শুধু নয়, প্রতি শুনানিতে সমপরিমাণ অর্থ নেন সরকারি কৌঁসুলিরা।’
টাঙ্গাইলের গমজানিতে মা-বাবার দেওয়া তিন বিঘা ধানি জমি পেয়েছিলেন এক নারী। তাঁর বাবা-মা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। তিনি চাকুরে স্বামীর সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন। এসে দেখেন তাঁর জমি শুধু অর্পিতই নয়, দখলও হয়ে গেছে। এ জমিটুকু তাঁর কাছে ছিল বাবা-মায়ের স্মৃতি। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন হওয়ার পর জমি ফিরে পেতে আবেদনের পর তিনি পক্ষে রায় পান। তবে আজ পর্যন্ত আপিলের রায় হয়নি। ওই নারীর স্বামী বলছিলেন, ‘ভিখারিদের যেমন করে সাহায্য দেয় মানুষ, সরকার আমাদের তেমনই মনে করতেছে। গত তিন বছরে আমার উকিল অর্পিতর মামলা কইরাই দোতলা বাড়ি পাঁচতলা করছে। ঢাকায় ফ্ল্যাট কিনছে। আমরা কিছু পাই নাই।’
গবেষণায় অর্পিতর আবেদনের রায়ের দীর্ঘসূত্রতার কারণ হিসেবে বিচারকের কম সংখ্যাকে একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিচারকেরা অর্পিতর আবেদনকে ‘বাড়তি কাজ’ বলে মনে করেন। সরকারি কৌঁসুলিরা বারংবার ইচ্ছাকৃতভাবে সময় চেয়ে আবেদন করেন। অনেক সময় বাদীর আইনজীবী আর্থিক সুবিধার জন্য মামলা দীর্ঘায়িত করেন।