\
‘আগে যদি জানতামরে বন্ধু তুমি হইবা পর, ছাড়িতাম কি বাড়ি আমার ছাড়িতাম না ঘর।’ কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘মনপুরা’ ছবির জনপ্রিয় এ গানের কয়েকটি কলিকেও হার মানিয়েছে সিলেটের জাফলংয়ের দুখিনী আরিফার বাস্তব জীবন। প্রেমের টানে ১৩ বছর বয়সে ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে করে এখন সব কুলই হারিয়েছেন এই কিশোরী গৃহবধূ। বিয়ের পাঁচ বছর যেতে না যেতেই স্বামীর নির্যাতন আর দুই ক্ষুধার্ত শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে চাপাকান্না করছেন। অবুঝ সন্তানদের নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বারান্দায় ২০ ঘণ্টা পড়ে থাকার পর অবশেষে গতকাল দুুপুরে মেডিসিন বিভাগ হয়ে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) আরিফার জায়গা মেলে। তবে তাকে দেখার কেউ নেই।
শনিবার বিকালে রোগে-শোকে আক্রান্ত ১৯ বছর বয়সি গৃহবধূ আরিফাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনেন তার শাশুড়ি শামসুন্নাহার। পুত্রবধূ ও দুই নাতনিকে জরুরি বিভাগের সামনে রেখে ইফতারি কিনতে যান শামসুন্নাহার। তারপর আর ফেরেননি শাশুড়ি। এমনকি তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। আড়াই বছরের কন্যা আয়শা আক্তার ও দেড় বছরের নূরুন নাহারের মুখে এক গ্লাস পানিও তুলে দিতে পারেননি অসহায় এই নারী। অতঃপর জরুরি বিভাগের মেঝেতে পড়ে থাকা আরিফার কান্নায় হাসপাতালের কর্মচারী ও দর্শনার্থী কিছু শুকনো খাবার দেয়। কিন্তু শারীরিকভাবে দুর্বল এই গৃহবধূ একটু খাবারও মুখে নিতে পারেননি। আরিফার বাড়ি জাফলংয়ের ছাতক খেওয়াপাড়া এলাকায়। স্বামী রাকিব হাসান এলাকায় জেলের কাজ করেন। হাসপাতালের ট্রলিতে করে মেডিসিন বিভাগে নেওয়ার আগ মুহূর্তে গতকাল দুপুর ২টার দিকে কথা হয় আরিফার সঙ্গে। কথা বলার সময় বারবার তার মুখ জড়িয়ে যাচ্ছিল। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ২০১০ সালে ছাতক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় এক বান্ধবীর মাধ্যমে তাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় রাকিব হাসান। বান্ধবীর কথায় আর অবুঝ বয়সের প্রথম প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় পূজা নামের মেয়েটি। এর কয়েক দিন যেতে না যেতেই হিন্দু-মুসলিম ধর্মে বাদ সাধে পূজার পরিবার। তাদের বাধার মুখেই প্রেমের মূল্য দিতে পূজা ধর্মান্তরিত হয়ে আরিফা নাম ধারণ করে রাকিব হাসানকে বিয়ে করেন। মেয়ে ধর্মান্তরিত আর বাল্যবিয়ের অপরাধে আইনি ঝামেলা এড়িয়ে আরিফার বাবা-মা তাকে ত্যাজ্য করেন।
আরিফা বলেন, বিয়ের পর বাবা-মা ও ছোট বোনকে ছেড়ে এসে স্বামীর দিন আনে দিন খায় রোজগারেও তার সংসার সুখেই কাটছিল। এরই মধ্যে একটি কন্যা আসে। কিন্তু দ্বিতীয় কন্যা আসার পর পরই তিনি দিন দিন স্বামীর শত্রুতে পরিণত হন। কথায় কথায় শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। বাবা-মা ত্যাজ্য করলেও সেখানে গিয়ে টাকা-পয়সা আনার জন্য রাকিব হাসান তাকে শারীরিক নির্যাতন করে আসছিল। অসহায় এ গৃহবধূ বলেন, সন্তানদের কথা ভেবে মুখ বুজে রাকিবের সব নির্যাতন সহ্য করে আসছিলাম। ভাবছিলাম নিজে ভুলে বিয়ে করেছি। মেয়ে দুটিকে যতœ করে বড় করব। বড় হলে তাদের বোঝাব যেন আমার মতো ভুল না করে। শাশুড়িও তাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করে। কিন্তু সীমাহীন নির্যাতনের মধ্যেই গত দেড় মাস আগে সেই রাকিব হাসান ঢাকায় চলে আসে। এখনো তার কোনো খবর নেই। বাড়িতে টাকা পাঠায় কিনা তাও জানি না। শাশুড়ির যখন ইচ্ছা খাবার দিত। এভাবে খেয়ে, না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে শাশুড়িই আবার দয়া দেখিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে আসেন। কিন্তু তিনিও হারিয়ে গেছেন। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ততক্ষণে দুচোখ ভেসে যায় আরিফার।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, আরিফার অবস্থা গুরুতর দেখে দুপুরে মেডিসিন বিভাগে ভর্তির পর তাকে ওসিসিতে স্থানান্তরিত করা হয়।
গতকাল দুপুরেও আরিফার স্বামী ও শাশুড়ির দুটি মোবাইল নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।