ঢাকা, এপ্রিল ২০, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ০৮:০৬:৩২

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র পুনর্বাসন না করে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা হবে না: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি হিসেবে ফের নিয়োগ পেলেন বিপ্লব বড়ুয়া সংসদ অধিবেশন উপলক্ষে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ আপিলে দ্বিতীয় দিনে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ৫১ জন নির্বাচনে ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনী চায় ইসি : পিএসও আদালত আবমাননায় বিচারক সোহেল রানার সাজার বিরুদ্ধে আপিলের রায় ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর ২১টি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৪ জন গ্রেফতার : ডিএমপি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কিনা, জানালেন ইসি

সোয়া ২ লাখ বৈধ অস্ত্রের মনিটরিং হচ্ছে না স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে

| ৬ কার্তিক ১৪২২ | Wednesday, October 21, 2015

Pistolনিউজ ডেস্ক :: বিভিন্ন সময়ে লাইসেন্স দেয়া সোয়া ২ লাখ বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র কিভাবে ব্যবহার হচ্ছে এর তথ্য নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এমনকি এর সুষ্ঠু মনিটরিংও হচ্ছে না। বৈধ উপয়ে অস্ত্রের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার অস্ত্রটি কিভাবে ব্যবহার করছেন, বা এগুলো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা নিয়ে মাথা ব্যথা নেই সংশ্লিষ্টদের। আগ্নেয়াস্ত্রের মতো এমন স্পর্শকাতর মারণাস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েই কেবল দায়িত্বমুক্ত থাকছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ফলে বৈধভাবে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটেই চলছে। দীর্ঘ দিন ধরে বৈধ অস্ত্র দিয়ে খুনখারাবি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও হত্যার হুমকি দেয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। এমনকি ভাড়ায়ও পাওয়া যাচ্ছে এসব অস্ত্র।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কয়েকটি চাঁঞ্চল্যকর ঘটনায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার নিয়ে দেশে তোলপাড় শুরু হয়। বিশেষ করে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের একজন এমপি নিরপরাধ এক শিশুর পায়ে নির্দয়ভাবে গুলী চালানোর ঘটনায় মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। মিডিয়ায় এসব খবর ফলাও করে প্রচারের পর কর্তপক্ষের টনক নড়ে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন- অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। দীর্ঘ দিনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রায় সোয়া দুই লাখ বৈধ অস্ত্র কিভাবে ব্যবহার হচ্ছে এ বিষয়ে মনিটরিং করার প্রস্তুতি চলছে। এসব অস্ত্র যাতে অন্যায়ভাবে ব্যবহার না হয় সেজন্য ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় কার্যক্রম শুরু করেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা প্রায় সোয়া দুই লাখ। বৈধভাবে নেয়া এসব অস্ত্র আসলে কিভাবে, কারা ব্যবহার করছে এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে নেই। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, পুলিশ, র‌্যাব ও জেলা প্রশাসকের কাছেও নেই। কারা কিভাবে অস্ত্রগুলো নিয়েছে এবং এগুলো সংশ্লিষ্টদের কাছে আছে কিনা তা যাচাই বাছাই করা দরকার। কেউ ভূঁয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে নিয়ে থাকলে বা অস্ত্রের লাইন্সেস পাওয়ার যোগ্য নয় এমন ব্যক্তির কাছে অস্ত্র থাকলে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। এসব লাইসেন্স বাতিল করে অস্ত্রগুলো সরকারের জমা নেয়া উচিৎ। তা না হলে এসব অস্ত্র একসময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায় সূত্র আরো জানায়, গত ৫ বছরে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত অবৈধ কাজে ব্যবহারের জন্য সারা দেশে প্রায় ৫শ বৈধ অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ৩১৮টির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৬টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ অস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নাসির আহমেদ জানান, কোনো নিয়মনকানুন ছাড়াই এখন অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে। অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে যেসব নিয়মন রয়েছে তা মানা হলে যার তার কাছে অস্ত্র চলে যেতো না। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে কঠোর নিয়মগুলো মানা হচ্ছে না। লাইসেন্স পাওয়ার একটি শর্তের মধ্যে বছরে তিনলাখ টাকা আয়কর রিটার্ন দাখিলের যে বিধিটি রয়েছে এটিও মানা হচ্ছে না। অপর একটি সূত্র জানায়, বিগত পাঁচ বছরে অন্তত ১০ হাজার অস্ত্রের লাইসেন্সের অনুমতি হয়েছে।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, বৈধ অস্ত্রও দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীকে এখন বৈধ-অবৈধ অস্ত্রধারীদের নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসীরা কীভাবে তাদের অপরাধ সাম্রাজ্য গড়ে তুলছে তার প্রমাণ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের নুর হোসেন। দুই ডজন হত্যা মামলার আসামী নুর হোসেন ও তার সহযোগীদের নামে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল ৯টি। একজন স্থানীয় নেতা কত অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে পারেনÑ তারও একটা উপমা মিলল। এই বৈধ অস্ত্র কিভাবে অবৈধভাবে ব্যবহৃত হয় তা-ও জনগণ প্রত্যক্ষ করল। বর্তমান সরকার প্রশাসন যন্ত্রকে কতটা নিয়ন্ত্রণ ও অসহায় করে দিয়েছে, অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিলেই কারো বুঝতে অসুবিধা হবে না।

রাজধানীর গুলশানে ২০১৩ সালে গুলী করে হত্যা করা হয় এক যুবলীগ নেতাকে। তদন্তে বেরিয়ে আসে আলোচিত এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত অপর এক যুবলীগ নেতা। চিহ্নিত সন্ত্রাসী হলেও তার নামেই রয়েছে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স। নিহত ও অভিযুক্ত এই দু’জনের একজনের ও পরিবারের অপর সদস্যের নামেই রয়েছে অন্তত ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স। ২০১১ সালে পল্লবীতে এক ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে চাঁদা আদায়ের চেষ্টাকালে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে জব্দ করা হয় লাইসেন্স করা একটি পিস্তল। এর আগের বছর রাজধানীতেই র‌্যাব আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক সদস্যের কাছ থেকে একটি গুলীভর্তি ক্ষুদ্র অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব দেখতে পায়, জব্দ অস্ত্রটি বৈধ। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর পরিচয়ে ভুয়া সনদ দেখিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সটি নিয়েছিলেন সেই দাগি সন্ত্রাসী।

গত কয়েক বছরে লাইসেন্স পাওয়া অস্ত্রধারীদের মধ্যে বিগত পাঁচ বছরে তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বিভিন্ন থানায় ফৌজদারি মামলা হয়েছে। তারপরও অভিযুক্ত কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নিজের কাছে অস্ত্র রাখছেন এবং সেই অস্ত্র সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহারের ফলে খুন, গুম, হত্যা, অপহরণ ও রাহাজানি অনেক গুণ বেড়েছে। বৈধ অস্ত্রের এমন অবৈধ ব্যবহারের অসংখ্য নজির থাকার পরও বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার ও নেয়ার জন্য তদবির চলছে। রাজনৈতিক ক্যাডারেরা প্রায় প্রতিদিনই মন্ত্রণালয়ের সংশি¬ষ্ট দফতরে অস্ত্রের লাইসেন্স পেতে জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সুপারিশ করা কাগজ নিয়েই মন্ত্রণালয়ে আসছেন।

খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ সন্ত্রাসী কার্যকলাপে বৈধ অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশিরভাগ ঘটনাতেই নাম আসছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের। সর্বশেষ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন তার লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই নিরপরাধ শিশু সৌরভের দুই পায়ে গুলী করেন। ওই ঘটনার পর ওই এমপির ১টি পিস্তলল ও ১টি শটগান থানায় জমা দেয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত ওই অস্ত্র ২টির লাইসেন্স বাতিল করা হয়নি। এমপি লিটনের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল তখন বলেছিলেন, মামলা হয়েছে। অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়েও পদক্ষেপ নেয়া হবে।

জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরেই দেশের ৬৪ জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের যত লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে, তার সিংহভাগই ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা পেয়েছেন। গত ১৩ এপ্রিল গভীর রাতে নিউ ইস্কাটনে একটি কালো রঙের প্রাডো গাড়ি থেকে এলোপাতাড়ি গুলী ছুঁড়লে এক অটোরিকশাচালক ও এক রিকশাচালক নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে গত ৩১ মে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পিনু খানের ছেলে রনি ও তার গাড়িচালক ইমরান ফকিরকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে পুলিশ তার পিস্তলটি জব্দ করে। অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করতে পুলিশের পক্ষ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ে আবেদনও করা হয়।

গত ১৫ আগস্ট দুপুরে শোক দিবসের র‌্যালি শেষে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের প্রভাবশালী দুই নেতার সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ১০ জন আহত হন। সংঘর্ষকালে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোমিনুর রহমান মোমিজের লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে পুলিশের বহিষ্কৃত এএসআই আনিচ জনসমক্ষে গুলী ছোড়েন। তার গুলীতে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের উপস্থিতিতেই এ ঘটনা ঘটে। পরবর্তীকালে জননিরপত্তা বিঘিœত ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে ব্যবহার হতে পারে- এ আশঙ্কায় কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদে থাকা সাত নেতার ১০টি অস্ত্র জব্দ ও লাইসেন্স বাতিল করা হয়।

জানা গেছে, অনেক জেলাতেই শুধু ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী হওয়ায় অনেক সন্ত্রাসীও বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছে। একটি অস্ত্রের লাইসেন্সের বিপরীতে তারা আরও বেশ কয়েকটি অবৈধ অস্ত্র দখলে রাখেন। এসব অস্ত্র খুনোখুনি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ব্যবহার করা হয়। অভিযোগ আছে, কোনো কোনো ঘটনা পুলিশও জানে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের হওয়ার কারণে কোনো পদক্ষেপ নেয় না।

সূত্র জানায়, মহাজোট সরকারের আমলে কয়েক হাজার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, যার অধিকাংশই রাজনৈতিক বিবেচনায়। যেসব ব্যক্তি নিজের নিরাপত্তায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন, তাদের একটা বড় অংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। এর বাইরে সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী ঘরাণার প্রভাবশালী রাজনীতিক, আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সুপারিশেও লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে। তবে বিগত ৫ বছরে বিএনপি ঘরাণার কোনো রাজনীতিককে ব্যক্তি-নিরাপত্তায় আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছে, এমন নজির নেই।