সিলেট শহরতলির কুমারগাঁওয়ে নির্মম ও পৈশাচিক কায়দায় পিটিয়ে ১৩ বছরের শিশু শেখ সামিউল আলম ওরফে রাজন হত্যা মামলায় ১৩ আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দিয়েছে পুলিশ। এতে প্রধান আসামি করা হয়েছে সদর উপজেলার টুকের বাজার ইউনিয়নের শেখপাড়া গ্রামের সৌদিপ্রবাসী কামরুল ইসলামকে। অন্য অভিযুক্তরা হলো কামরুলের দুই ভাই মুহিত আলম ও আলী হায়দার, আজমত উল্লাহ, ফিরোজ মিয়া, চৌকিদার ময়না মিয়া, দুলাল আহমদ, নূর মিয়া, তাজউদ্দিন বাদল, আয়াজ আলী, শামীম আহমদ, পাভেল আহমদ ও রুহুল আমিন। এদের মধ্যে শামীম, পাভেল ও কামরুল ছাড়া অন্য ১০ জনই সিলেট কারাগারে আটক। কামরুল ইসলাম সৌদি আরবে পালিয়ে যাওয়ার পর সেখানে স্থানীয় বাংলাদেশিরা তাকে ধরে পুলিশে দেয়। সে এখন সৌদি কারাগারে আছে। গতকাল রবিবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিলেট মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক সুরঞ্জিত তালুকদার সিলেট মহানগর মুখ্য হাকিম দ্বিতীয় আদালতের বিচারক ফারহানা ইয়াসমিনের আদালতে এ চার্জশিট (নম্বর ৮১) দাখিল করেন। আজ সোমবার শুনানির জন্য এটি আদালতে তোলা হবে।
অভিযুক্তদের মধ্যে আটজন এরই মধ্যে হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে মুহিত আলম, তার ভাই আলী হায়দার, ভিডিও চিত্র ধারণকারী নূর মিয়া, আয়াজ আলী, দুলাল আহমদ, চৌকিদার ময়না মিয়া, ফিরোজ আলী ও আজমত উল্লাহ। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
চার্জশিটে মুহিতের স্ত্রী লিপি বেগম, লিপি বেগমের বড় ভাই ইসমাইল হোসেন আবলুছকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তাঁরা দুজনও কারাগারে আছেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সুরঞ্জিত তালুকদার বলেন, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আটজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তদন্তে গ্রেপ্তারকৃতরা ছাড়াও শামীম ও পাভেলের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তাদেরও চার্জশিটভুক্ত করা হয়েছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ বলেন, কামরুল ইসলামকে সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবেন।
রাজন কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাদেআলী গ্রামের মাইক্রোবাসচালক শেখ আজিজুর রহমানের ছেলে। সে স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত। পাশাপাশি নিজের বাড়িতে ফলানো সবজি বাজারে বিক্রি করে সংসারে সাহায্য করত।
গত ৮ জুলাই সকালে প্রতিদিনের মতো রাজন সবজি নিয়ে বাজারে যায়। এ সময় স্থানীয় চৌকিদার ময়না মিয়া মিথ্যা চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে ধরে একটি ওয়ার্কশপের লোহার খুঁটিতে বাঁধে। খবর পেয়ে কামরুল ও তার ভাইরা এসে কাঠের রোল দিয়ে বেধড়ক পিটুনি শুরু করে। একপর্যায়ে রাজন পানি খেতে চাইলে কামরুল প্রথমে ওই রোলটি ড্রেনের নোংরা পানিতে ভিজিয়ে তাকে চেটে খেতে বাধ্য করে। দ্বিতীয়বার পানি চাওয়ায় কামরুল রাজনকে বলে, তোর শরীর থেকে ঘাম বের হচ্ছে, ওই ঘাম চেটে খা।
নির্যাতনের পুরো ঘটনা নূর মিয়া মোবাইল ফোনের ভিডিওতে ধারণ করে। পরে নির্যাতনকারীরা সেই ভিডিওটি ফেসবুকে আপলোড করে। এ পৈশাচিক ঘটনার খবর মুহূর্তে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সিলেটসহ সারা দেশে আন্দোলন শুরু হয়।
এরপর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা রাজনের বাড়িতে আসেন। তাঁরা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নেওয়ার ঘোষণা দেন।
আট আসামির দেওয়া জবানবন্দিতে রাজনের ওপর নির্যাতনের করুণ কাহিনীর পাশাপাশি লাশ গুম চেষ্টারও তথ্য উঠে আসে। হত্যাকারীরা একটি মাইক্রোবাসে (ঢাকা মেট্রো-চ-৫৪-০৫১৬) তুলে রাজনের লাশ কুমারগাঁয়ে নিয়ে গেলে ৮ জুলাই বিকেলে জনতা মুহিত আলমকে আটক করে। পুলিশ লাশ উদ্ধার ও মুহিতকে আটক এবং একটি মামলা করে। বাদী হন এসআই আমিনুল।
রাজনের বাবার সঙ্গে পুলিশের দুই কর্মকর্তার অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং টাকার বিনিময়ে প্রধান অভিযুক্তকে বিদেশ পালিয়ে যেতে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এস এম রুকন উদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওসি আলমগীর হোসেন, এসআই আমিনুল ইসলাম ও এসআই জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।