ঢাকা, মার্চ ২৯, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, স্থানীয় সময়: ১৮:০৫:২৬

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

আসন্ন পবিত্র রমজানে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্বারোপ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় আসার নিশ্চয়তা না পেয়ে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে : প্রধানমন্ত্রী মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পৃক্ততার আহ্বান তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর সংসদে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে স্বতন্ত্র সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী প্রকল্প বাস্তবায়নে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে পিপিপি বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আগমন স্বচ্ছ নির্বাচনে সহায়ক : তথ্যমন্ত্রী ফোর্বসের শীর্ষ ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় শেখ হাসিনা ৪৬তম বিএনপি-জামায়াত সারাদেশে বিশৃঙ্খলার ষড়যন্ত্র করছে : ওবায়দুল কাদের

সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর

| ৮ অগ্রহায়ন ১৪২২ | Sunday, November 22, 2015

Saka.jpg1

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি অবশেষে কার্যকর করা হয়েছে। গতকাল শনিবার রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে শীর্ষস্থানীয় এই দুই অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে জানিয়েছেন আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও একই তথ্য দিয়েছেন। রাত ১টা ৫৪ মিনিটে কারাগারের ফটকে জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবির সাংবাদিকদের জানান, রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে একই সঙ্গে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। কারা সূত্রে জানা যায়, একই মঞ্চে একই সঙ্গে পাশাপাশি কার্যকর করা হয় দুজনের ফাঁসি। এর মধ্য দিয়ে দেশে প্রথম কোনো মন্ত্রীর ফাঁসি কার্যকর হলো। দণ্ডিত দুই অপরাধীই ভিন্ন ভিন্ন সরকারের সময় মন্ত্রী ছিলেন। দুজনের মধ্যে একাত্তরের কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর প্রধান মুজাহিদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে এটিই প্রথম ফাঁসি। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এ নিয়ে চারজনের ফাঁসি কার্যকর হলো।

ফাঁসি কার্যকর শেষে রাত ২টা ৫১ মিনিটে লাশ নিয়ে প্রথম অ্যাম্বুল্যান্সটি বেরিয়ে আসে কারাগারের ভেতর থেকে। পরপরই বাকি অ্যাম্বুল্যান্সগুলোও বেরিয়ে আসে। ২টা ৫৫ মিনিটে র‌্যাব ও পুলিশ প্রহরায় সাকা চৌধুরীর লাশ নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে এবং মুজাহিদের লাশ নিয়ে ফরিদপুরের উদ্দেশে রওনা দেয় অ্যাম্বুল্যান্সগুলো। ওই সময় কারাগারের সামনে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। কেউ কেউ জুতাও প্রদর্শন করে। তখন ‘সাকার দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ এবং ‘মুজাহিদের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ বলেও স্লোগান দেওয়া হয়।

বিচার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দম্ভোক্তি প্রকাশকারী দুই মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার আগে কারাগার এলাকায় জড়ো হন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা  এবং গণজাগরণ মঞ্চের কয়েকজন কর্মী। তাঁরা সাকা ও মুজাহিদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবিতে স্লোগানও দেন।

এর আগে গতকাল দুপুরে দুই ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন সাকা ও মুজাহিদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় হয়ে সেই আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছে গত রাতে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাষ্ট্রপতি তাঁদের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেন। এর পরপরই কারা কর্তৃপক্ষ দুই অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার চ‚ড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করে। এর অংশ হিসেবে সাকা ও মুজাহিদের পরিবারের সদস্যদের ডাকা হয় শেষবারের মতো দেখা করার জন্য। রাত সাড়ে ৯টায় সাকা পরিবারের ১৮ জন এবং রাত ১০টা ৫৫ মিনিটে মুজাহিদের পরিবারের ১৩ সদস্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে যান। সাক্ষাৎ শেষে স্বজনরা বেরিয়ে যাওয়ার পরই আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, কারা তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবির, ঢাকার জেলা প্রশাসক মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, দুই ম্যাজিস্ট্রেট ও কারা কর্মকর্তা, পুলিশ, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ফাঁসির মঞ্চে যান। ১২ জন করে সশস্ত্র কারারক্ষী দণ্ডিত একেক অপরাধীকে ঘিরে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান। রাত ১২টা ৩৪ মিনিটে কারাগারের ভেতরে ঢুকে চারটি অ্যাম্বুলেন্স।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এরপর গত ১১ এপ্রিল কার্যকর করা হয় আরেক জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি। গত রাতে কার্যকর করা হলো সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসি।

ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় উপস্থিত ছিলেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন, জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর কবির, কারাধ্যক্ষ নেছার আলম, কারা চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা। দণ্ড কার্যকর করতে প্রধান জল্লাদ ছিলেন শাহজাহান। তাঁর সহযোগী হিসেবে ছিল আবুল, হজরত, মাসুদ, ইকবাল, রাজুসহ ১২ জন।

এর আগে দণ্ডিতদের তওবা পড়ান কেন্দ্রীয় কারাগার মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মনির হোসেন খান। ইমামকে নিয়ে কারা কর্মকর্তারা আট সেলে থাকা সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের কাছে যান। পরে ইমাম সাহেব তাঁদের তওবা পড়ান। আগেই তাঁরা ওজু করে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছিলেন। এশার নামাজ আদায়ের পর তাঁরা নফল নামাজও আদায় করেন। দণ্ডিতরা তওবা পড়ার কিছুক্ষণ পর সশস্ত্র কারারক্ষীসহ কনডেম সেলে যান জল্লাদরা।

কারাগারে নির্বাহী আদেশ : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ার পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয় দুই অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করার। সেই নির্দেশ অনুযায়ী রাত ১২টার পর দুজনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এর আগে গতকাল দুপুরে তাঁদের স্বাস্থ্যগত পরীক্ষাও সম্পন্ন করা হয়।

দুই অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করতে বৃহস্পতিবার বিকেলেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ। এর পর থেকেই তাঁদের ফাঁসি কখন কার্যকর করা হচ্ছে তা নিয়ে সারা দেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়। কিন্তু দুই অপরাধী রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন কি না, তা নিয়ে কালক্ষেপণ করায় ফাঁসি কার্যকর করতে দেরি হয় কিছুটা। অবশেষে গতকাল দুপুরে ম্যাজিস্ট্রেটদের সামনে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন তাঁরা। পরে সেটি কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর পর রাষ্ট্রপতি সেটি নাকচ করে দেন। রাষ্ট্রপতি ওই আবেদনে এককথায় ‘আবেদন নামঞ্জুর’ লিখে ফেরত পাঠান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। রাষ্ট্রপতির আদেশের কপি লাল খামে করে রাত ১০টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

ফাঁসি কার্যকর করার আগে থেকেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশ এলাকায় নেওয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। কারাগার ঘিরে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়।

পরিবারের সদস্যদের শেষ সাক্ষাৎ : রাত সাড়ে ৯টায় সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিবারের ১৮ জন কারাগারের ভেতরে যান এবং সাকা চৌধুরীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সাকার ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, ফইয়াজ কাদের চৌধুরী, পুত্রবধূ দানিয়াত খন্দকার চৌধুরী, মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী, ভাই জামাল উদ্দিন কাদের চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, ভাতিজা শাকিব কাদের চৌধুরী, নিকটাত্মীয় সাঈদ আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ। এর আগে রাত ৯টা ৫ মিনিটে সাকা চৌধুরীর পরিবারের ২৫ সদস্য যান কারা ফটকে। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে সাকার স্ত্রী-সন্তানসহ ১৮ জন ভেতরে যান। প্রায় এক ঘণ্টা সাক্ষাৎ শেষে রাত ১০টা ৫০ মিনিটে তাঁরা বেরিয়ে যান। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কাউকে কাউকে তখন কাঁদতে দেখা যায়। বাইরে এসে সাকা চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাবা প্রাণভিক্ষা চাননি। প্রাণভিক্ষার আবেদন সাজানো।’কারাগারে যাওয়ার আগে সাকার স্ত্রী ও দুই ছেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।

সাকা পরিবার বেরিয়ে আসার পর রাত ১০টা ৫৫ মিনিটে মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা কারাগারের ভেতরে যান তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। এর আগে মুজাহিদের পরিবারকে ডেকে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ। খবর পেয়ে মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না-ই জাহানের নেতৃত্বে পরিবারের ১৩ সদস্য কারাগারে যান।

ফাঁসি কার্যকর হতে যাচ্ছে-এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারা দেশে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়াও এ খবর প্রচার করে। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অব্যাহত থাকে এ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। রাত সোয়া ১২টার কিছু পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। হঠাৎ করেই কারাগারের ভেতর থেকে কর্মকর্তারা বেরিয়ে আসেন।

রিভিউ আবেদন খারিজ : রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত ১৪ অক্টোবর আবেদন করেন তাঁরা। এ রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে তা খারিজ করে গত বুধবার রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। এরপর রিভিউ খারিজ-সংক্রান্ত রায়ের কপি গত ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় কারাগারে পৌঁছায়। পরে তাঁদের রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার রায় পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কি না তা জানতে চাওয়া হয় দুই অপরাধীর কাছে।

দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রাণভিক্ষার আবেদন : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলর নেসার আলম, ডেপুটি জেলর আরিফ হোসেন ও সর্বোত্তম দেওয়ান দুপুর ১টা ৫৫ মিনিটে একটি গাড়িতে করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। তাঁরা সেখানে স্বরাষ্ট্রসচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খানের কাছে দুই অপরাধীর করা প্রাণভিক্ষার আবেদন নিয়ে যান। দুপুর সোয়া ২টার দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে কারাগারে ফিরে যান তাঁরা। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে সেই আবেদন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ মোহাম্মদ জহিরুল হকের কাছে পাঠানো হয়। আইনসচিব সেখান থেকে আবেদনটি আইনমন্ত্রীর মতামতের জন্য নিয়ে যান গুলশানে আইনমন্ত্রীর বাসায়। ভেটিং শেষে আইন ও স্বরাষ্ট্রসচিব সেটা নিয়ে যান বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে। এরপর রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে তাঁরা বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, রাষ্ট্রপতি আবেদন দুটি নাকচ করে দেন। তবে এ বিষয়ে বঙ্গভবন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। এরপর রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত-সংবলিত চিঠি কারাগারে পৌঁছে দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বঙ্গভবন ও কারা ফটকে সাকা পরিবার : গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চিঠি নিয়ে বঙ্গভবনে যান সাকা চৌধুরীর স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী ও ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। বঙ্গভবনের ফটকের সামনে গাড়িতে বসে ছিলেন ফারহাত কাদের চৌধুরী। ‘পিটিশন টু দ্য অনারেবল প্রেসিডেন্ট ফ্রম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী’ শিরোনামের চিঠিটি নিয়ে হুম্মাম কাদের চৌধুরী যাওয়ার পর তাঁকে মূল ফটকের অভ্যর্থনা কক্ষে বসানো হয়। এরপর তাঁকে জানানো হয়, রাষ্ট্রপতির কাছে সরাসরি কোনো আবেদন করা যায় না। আবেদন গ্রহণ না করায় বিকেল সোয়া ৫টায় তাঁরা যান কারা ফটকে। তাঁরা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তাঁদের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বঙ্গভবনে যাওয়ার আগে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁরা। এরপর রাতে সাকা পরিবারের সদস্যদের ডেকে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ।

সাকার ওজন ৯০, মুজাহিদের ৭৩ কেজি : মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করার সময় ঘনিয়ে আসায় আলী আহসান মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছিল তিন দিন ধরে। কারা চিকিৎসক গিয়ে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। কারা সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকাল ১১টার দিকে কারা চিকিৎসক ডা. বিপ্লব কান্তি দাস তাঁদের চেকআপ করতে যান। তিনি তাঁদের রক্তচাপ মাপার পাশাপাশি ওজনও মাপেন। সাকা চৌধুরীর ওজন পাওয়া যায় ৯০ কেজি আর মুজাহিদের ৭৩ কেজি। তাঁদের ওজন মেপে কারাগারে ফাঁসির মঞ্চে মহড়াও দেওয়া হয়েছে। এতে তাঁদের ওজনের পরিমাণ ইট একটি বস্তায় ভরে সেটির মধ্যে যে রশি দিয়ে ফাঁসি দেওয়া হবে সেই রশি কতটুকু শক্ত তা পরীক্ষা করা হয়।

প্রাণভিক্ষার আবেদন : মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। তবে এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘ওই দুজন প্রাণভিক্ষা না চাইলে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর প্রশ্নই উঠত না। তাঁরা আবেদন করেছেন। সেই আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত জানাবেন। রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’

এর আগে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদকে তাঁদের রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ হওয়ার রায় পড়ে শোনানো হয়। ওই সময় কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানায় যে শেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। দুই অপরাধীকে আরো জানানো হয়, অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। কিন্তু দুজনই তখন সময় চান। এ বিষয়ে তাঁরা আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে চান। পরদিন আবার কারা কর্মকর্তারা তাঁদের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে ম্যাজিস্ট্রেট এসেছেন কি না জানতে চান তাঁরা। পরে কারা কর্তৃপক্ষ তাঁদের সময় দেয়। অবশেষে গতকাল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে তাঁরা প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা যায়, রাষ্ট্রপতির কাছে দুই অপরাধী প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না সেটা জানতে গতকাল সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফ হোসেন ও তানভির আহমেদ। বিকেল ৩টা ৩০ মিনিটের দিকে তাঁরা বেরিয়ে যান।

বিচার ও আপিলের রায় : মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে গত ১৬ জুন সংক্ষিপ্ত রায় দেন আপিল বিভাগ। এ ছাড়া সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগ গত ২৯ জুলাই সংক্ষিপ্ত রায় দেন। সাবেক এই দুই মন্ত্রীর আপিল মামলায় আলাদা দিনে রায় দেওয়া হলেও গত ৩০ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আপিল বিভাগ। এর পরদিন মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের জারি করা মৃত্যু পরোয়ানা পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ। জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মামলায় আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী রিভিউ আবেদন করতে ১৫ দিন সময় পায় সংশ্লিষ্ট পক্ষ। এ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিভিউ আবেদন দাখিল করেন মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরী। তাঁদের পক্ষে আইনজীবীরা আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিভিউ আবেদন জমা দেন।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মুজাহিদ গ্রেপ্তার হন। একই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি ছিলেন কারাবন্দি।

হরতালে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর ও পোড়ানোর অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাকা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর তিন দিন পর ১৯ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি ছিলেন কারাবন্দি।

মুজাহিদের আইনজীবীরা কারাগারের সামনে : মুজাহিদের সঙ্গে দেখা করতে গতকাল দুপুর থেকেই আইনজীবীরা কারাগারের সামনে অবস্থান করেন। গতকাল বিকেলে কারাগারে যান মুজাহিদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট গাজী এইচ এম তামিম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৯ নভেম্বর আইনজীবীদের সাক্ষাতের জন্য যে আবেদনটি করা হয়েছিল সেই আবেদনের বক্তব্যে এবং মুজাহিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার মিডিয়ায় প্রচারিত সংবাদের সত্যতা জানার বিষয়টি উল্লেখ করেছি। আমরা বলেছি যে মিডিয়ায় যেটা প্রচারিত হচ্ছে সেটা ভিত্তিহীন। কারণ ১৯ তারিখ পরিবারের সদস্যদের কাছে মুজাহিদ বলেছিলেন, তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা বিষয়ে পরামর্শ করবেন। কিন্তু কারা ফটকের অভ্যর্থনা শাখা থেকে আমাদের জানানো হয়েছে যে ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইনজীবীদের কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না।’

এর আগে দুপুরে মুজাহিদের পরিবার সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে ২১ আগস্ট মামলার বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দণ্ড কার্যকর না করার জন্য মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না-ই জাহান রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন জানান।