ঢাকা, এপ্রিল ২৫, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ২২:৫৪:৩১

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

পূর্ব লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল জিম্মি চুক্তিতে হামাসকে রাজি করাতে মিসর ও কাতারের দ্বারস্থ বাইডেন দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক মহড়া চীনের গাজা যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়েছে রমজানে মুসলমানদের আল আকসায় নামাজ পড়ার অনুমতি দিতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ গাজায় তুমুল যুদ্ধ ॥ চলছে যুদ্ধবিরতির বৈঠক জর্ডানে মার্কিন সৈন্য হত্যা ॥ দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার অঙ্গীকার যুক্তরাষ্ট্রের গাজা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে জাতিসংঘ দূতদের সাক্ষাত জি৭ নেতাদের ভিডিও শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী না হলে বাইডেন ও অনিশ্চিত

সর্বোচ্চ ৫২ টাকায় খতিয়ান!

| ২৫ পৌষ ১৪২১ | Thursday, January 8, 2015

এসএ, সিএস, বিআরএসসহ জমিসংক্রান্ত বিভিন্ন দলিলের আবেদন এখন অনলাইনেই করা যায়। ফলে ভোগান্তি ছাড়াই দ্রুত সেবা পাচ্ছে নাগরিকরা। পাশাপাশি সরবরাহকৃত জমির রেকর্ডও ডিজিটালাইজ হয়ে যাচ্ছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন তুহিন মাহমুদ

ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জমির পর্চা হাতে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ঝাঔল ইউনিয়নের রাবেয়া বেগম। খুশির কারণ কী? জিজ্ঞেস করতে জানালেন, এই জমির পর্চা সংগ্রহ করার জন্য তাঁর স্বামী অটো চালানো বাদ দিয়ে ২৫ কিলোমিটার দূরের জেলা প্রশাসনে গিয়ে কয়েক দিন নিয়মিত ধরনা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। এরপর তিনি স্থানীয় স্কুলশিক্ষকের কাছে জানতে পারেন পর্চা নাকি এখন তাঁদের ইউনিয়ন পরিষদেই পাওয়া যাচ্ছে। খবরটি অবিশ্বাস্য ঠেকলেও পরখ করতে এসেছিলেন সপ্তাহখানেক আগে। এসে জানতে পারেন, খবরটি সত্য। সেদিনই আবেদন করেছিলেন। সপ্তাহ না ঘুরতেই সরবরাহ করা হয়েছে সেটি। কাঙ্ক্ষিত সেই পর্চা হাতে পেয়েই রাবেয়া বেগম এত খুশি। রাবেয়া খাতুনের মতো গত কয়েক মাসে দেশের তিনটি জেলার ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার থেকে ৫৭ হাজার পর্চা পেয়েছে আবেদনকারীরা। এ সবই সম্ভব হয়েছে সরকারের ডিজিটাল-ল্যান্ড রেকর্ড সার্ভিস (ডিএলআরএস) চালুর ফলে।

পর্চা কী?

সরকারিভাবে জরিপ করা জমিজমার বিবরণসংবলিত সরকারি দলিলই ‘খতিয়ান’। এই খতিয়ানে থাকে মৌজার দাগ অনুসারে ভূমির মালিকের নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, মালিকানার বিবরণ, জমির বিবরণ, মৌজা নম্বর, মৌজার ক্রমিক নম্বর (জেএল নম্বর), সীমানা, জমি শ্রেণি দখলকারীর নাম, অংশ প্রভৃতির হিসাব। আর এই খতিয়ানের অনুলিপিকেই বলে ‘পর্চা’। পর্চার প্রয়োজনীয়তা

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দলিল এই পর্চা। জমি কেনার সময় ক্রেতাকে অবশ্যই জরিপের মাধ্যমে প্রণীত খতিয়ান ও নকশা যাচাই করতে হয়। এর সাহায্যে জমির মৌজা, খতিয়ান ও দাগ নম্বর, দাগে জমির পরিমাণ জানা সম্ভব। শুধু জমি কেনাবেচাই নয়, জমি রক্ষণাবেক্ষণ এবং দখলে রাখার ক্ষেত্রেও পর্চার বেশ গুরুত্ব রয়েছে। পর্চায় কোনো রকম সমস্যা থাকলে মালিকানাসংক্রান্ত, জমি কেনাবেচা কাজে বাধা তৈরি হয়। তাই পর্চায় কোনো সমস্যা থাকলে দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। মালিকানা নির্ধারণে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।

ডিজিটাল-পর্চা

আগে জমির পর্চা তুলতে সবাইকে জেলা সদরের রেকর্ড রুম (জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবস্থিত জমিসংক্রান্ত তথ্য ভাণ্ডার) থেকে আবেদন করতে হতো। হাতে লেখা পর্চা তুলতে সময় লেগে যেত ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত। অল্প দিনে পর্চা বের করে দেওয়ার নামে ছিল দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যও। তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিত। এসব ভোগান্তি থেকে রেহাই দিতে ২০১১ সালে যশোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমান অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে জমির পর্চা সরবরাহ করার উদ্যোগ নেন। পরে একই বছরের নভেম্বর মাসে দেশের বাকি ৬৩টি জেলায় কাউন্টার, সার্ভার রুম সেটআপের মাধ্যমে অনলাইনে জমির পর্চা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সে ক্ষেত্রেও আবেদনকারীকে জেলা সদরে যেতে হতো।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের আইটি ব্যবস্থাপক ফরহাদ জাহিদ শেখ জানান, ২০১২ সালে ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টার থেকে একইভাবে জমির পর্চা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সারা দেশ থেকে গ্রাহকদের মতামতের ভিত্তিতে ২০১৩ সালে ‘পাইলট প্রকল্প’ হিসেবে সিরাজগঞ্জের ৩০টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) থেকে ডিজিটাল ল্যান্ড রেকর্ড সার্ভিস (ডিএলআরএস) সিস্টেম চালু করা হয়। আশানুরূপ সাড়া পাওয়ায় পরে রংপুর ও কুড়িগ্রামের সব ইউডিসিতে এই সিস্টেম চালু করা হয়েছে। গত কয়েক মাসে এসব ইউআইসি থেকে প্রায় ৫৭ হাজার ই-পর্চা সরবরাহ করা হয়েছে।

অনলাইন প্রক্রিয়া

বর্তমানে সাধারণত তিনভাবে জমির খতিয়ান তোলা যায়। এগুলো হলো-জেলা ই-সেবাকেন্দ্র, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার এবং জেলা ওয়েব পোর্টাল। প্রথমত, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জেলা ই-সেবাকেন্দ্রের মাধ্যমে ওয়ানস্টপ সার্ভিসে জমির খতিয়ান তোলা যায়। দ্বিতীয়ত, দেশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে অবস্থিত ইউডিসি থেকেও খতিয়ান তোলার জন্য আবেদন করা যায়। এ ক্ষেত্রে ইউডিসি উদ্যোক্তারা সরকার নির্ধারিত কোর্ট ফি ছাড়াও জেলা প্রশাসন থেকে নির্ধারিত হারে সেবা চার্জ (প্রসেসিং ফি) গ্রহণ করেন। আর জেলা তথ্য বাতায়নে সংশ্লিষ্ট জেলার ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে কারো সহযোগিতা ছাড়াই ঘরে বসে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করা যায়। এ জন্য প্রথমে www.bangladesh.gov.bd ঠিকানায় নির্দিষ্ট জেলার ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে ‘নকলের জন্য আবেদন’-এ ক্লিক করে ফরম পূরণ করতে হবে।

খতিয়ানের জন্য নিজে অনলাইনে আবেদন করলে প্রয়োজন হবে জেলা প্রশাসক কর্তৃক নির্ধারিত ফি (৩১ থেকে ৫২ টাকা)। আর ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ফরম পূরণ করে আবেদন করলে কোর্ট ফি ছাড়া ডেলিভারি চার্জ দেওয়া লাগবে। অনলাইনে আবেদন করা জমির খতিয়ান ডাকযোগেও পাওয়া সম্ভব। এ জন্য অনলাইনে নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো যেমন নাম, জাতীয় আইডি, বর্তমান ঠিকানা, মোবাইল, টেলিফোন নম্বর, নকলের ধরন যেমন জরুরি নাকি সাধারণ, উপজেলা, মৌজা, জেএল নম্বর, খতিয়ান নম্বর, খতিয়ানটি জেলা সেবাকেন্দ্র থেকে নাকি ডাকযোগে, কোর্ট ফি জেলাসেবাকেন্দ্রে নাকি ডাকযোগে প্রেরণ করবেন সেটি উল্লেখ করতে হয়। এসব তথ্য পূরণ করে নিচের দিকে ‘দাখিল করুন’ বাটনে ক্লিক করতে হয়। এরপর আবেদনকারীর মোবাইলে এসএমএস আসবে, যা ডিজিটাল রসিদ হিসেবে বিবেচিত হবে। এরপর রসিদের নম্বর অনুযায়ী কোর্ট ফি ডাকযোগে জেলা ই-সেবাকেন্দ্রে জমা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে খামের ওপর জেলা ই-সেবাকেন্দ্র, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও তার নিচে সংশ্লিষ্ট জেলার নাম উল্লেখ করতে হয়।

আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে সিরাজগঞ্জ, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায় অনলাইনের মাধ্যমে কোর্ট ফি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে আবেদনকারীদের আলাদাভাবে কোর্ট ফি কেনার প্রয়োজন হয় না। আবেদনকারী আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা এসএমএস কিংবা অনলাইনের মাধ্যমে জানতে পারবেন। এ ছাড়া নিজ ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে জেলা প্রশাসক কর্তৃক নির্ধারিত কোর্ট ফি ও ডেলিভারি চার্জ প্রদানের মাধ্যমে আবেদন করা সম্ভব।

আবেদনের পর

খতিয়ানের (পর্চা/নকল) আবেদনের পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট রেকর্ড রুমের কর্মকর্তারা কয়েক ধাপে কাজ সম্পন্ন করেন। আবেদন পাওয়ার পর অফিস সহকারী (প্রাথমিক বাছাইকারী) আবেদন যাচাই-বাছাই করেন এবং মৌজা বা উপজেলাভিত্তিক শর্টিং করেন। শর্টিং করার পর সহকারী মৌজার বই সংগ্রহ করেন। অতঃপর মৌজার বই থেকে আবেদন করা খতিয়ানের মূল তথ্য এন্ট্রি করা হয়। এরপর যাচাইকারীরা যাচাই-বাছাই করে তুলনাকারীর কাছে পাঠান। তুলনাকারী রেকর্ডটি তুলনা করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সহকারী কমিশনারের (রেকর্ড রুম) কাছে পাঠান। সহকারী কমিশনারের চূড়ান্ত অনুমোদনের পরই আবেদনকারীকে নির্ধারিত খতিয়ান দেওয়া হয়। প্রথম দিকে সংশ্লিষ্টদের স্বাক্ষর দেওয়া না হলেও এখন ই-পর্চাতে ডিজিটাল স্বাক্ষর দেওয়া হয়। ফলে এটির নির্ভরযোগ্যতা তৈরি হয়েছে।

কমছে দুর্নীতি

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) থেকে অনলাইনে জমির পর্চা ও খতিয়ান গ্রহণ চালু করায় এই সেবা প্রদানে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল শ্রেণির দৌরাত্ম্য ও প্রশাসনের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি কমেছে। আগে খতিয়ান বা পর্চা গ্রহণ করতে গেলে কয়েক দিন জেলা রেকর্ড রুমে ধরনা দিতে হতো। ছিল টাকা-পয়সার অবৈধ লেনদেন। এখন আর সেই সুযোগ নেই। সরকার নিকটস্থ ইউডিসি বা ডাকযোগে খতিয়ান, পর্চার জন্য আবেদন গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করায় মধ্যস্বত্বভোগীরা এখন আর সেই সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে নির্ধারিত ফির বিনিময়ে ঘরে বসেই নিজের খতিয়ান, পর্চা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে সাধারণ জনগণের কাছে সরকারের এই সেবা বেশ সাড়া ফেলেছে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও সরকারের এক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের যৌথ উদ্যোগে ৬৪ জেলার রেকর্ডরুমের সব রেকর্ড এসএ, সিএস, বিআরএস ও খতিয়ান কপি ডিজিটালাইজ করা হচ্ছে। আনুমানিক ২০১৭ সালের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন হবে। সহযোগিতায় রয়েছে এটুআই। এতে প্রায় সাড়ে চার কোটি খতিয়ান রেকর্ড ডিজিটালাইজ হবে। আর এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে আনুমানিক ৯২ কোটি টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রকল্পের জন্য অর্থও বরাদ্দ করা হয়েছে। কারিগরি সহায়তা করছে এটুআই। ইতিমধ্যে দেশের সবকটি জেলা প্রশাসনে প্রয়োজনীয় ল্যাপটপ দেওয়া হয়েছে।

২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত আনুমানিক ১৮ লাখ ডিজিটাল পর্চা প্রদান করা হয়েছে। এসব রেকর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনলাইনে সংরক্ষিত হওয়ায় হারানো বা নষ্টেরও ভয় নেই।