ঢাকা, এপ্রিল ১৯, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১০:৪২:৪৯

রাস উত্সবের ইতিহাস

| ২০ কার্তিক ১৪২৪ | Saturday, November 4, 2017

Image may contain: outdoor

কার্তিক পূর্ণিমার রাত বৈষ্ণবদের বড় প্রিয়। এ রাতেই তাদের প্রাণের উৎসব রাস উদযাপিত হয়। তাই ভজনকুটিরের নিকোনো উঠোনে আলপনা, উঠোনের পূর্ব কোণে টাঙানো ছোট্ট একখানি চাঁদোয়া। তার নীচেই রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। বড় মায়াময় সে মূর্তি। উঠোনের এক কোণে মঞ্জরীভরা তুলসী গাছের ঝাড়। কার্তিকের জ্যোৎস্নার দুধ-সাদা আলোয় আটপৌরে ভজনপ্রেমের চেনা পরিবেশ কেমন যেন অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে। কাঠের ছোট সিংহাসনে বসানো যুগলবিগ্রহের চার পাশে গোল করে সাজানো অষ্টসখীর মূর্তি। পরনে জমকালো পোশাক। সামনে ফরাস পাতা। তাতে সাজানো মৃদঙ্গ, মন্দিরা, হারমোনিয়াম, করতাল এবং আড়বাঁশি। সুগন্ধী ধূপ, আতর এবং ফুলের গন্ধে ম ম করে চারপাশ।

সন্ধ্যারতি শেষ। কপাল থেকে নাক পর্যন্ত তিলকপরা এক মাঝবয়েসি বৈষ্ণবভক্ত বিগ্রহের দিকে হাতজোড় করে প্রণাম করে তুলে নিলেন আড়বাঁশিটি। গভীর শান্ত চোখ দুটি বুজে আলতো ফুঁয়ে ধরলেন আলাপ। রাগ কেদার। বাঁশির সুরে ভজনকুটিরের উঠোনে ক্রমশ বুঁদ হয়ে উঠেছে রাস পূর্ণিমার রাত। ভিড় বাড়ছে আসরে। এ বার বাঁশির সঙ্গে ‘নিখুঁত কণ্ঠ’ মিলিয়ে বৈষ্ণবী গেয়ে উঠলেন মহাজনপদ—
বলয়া নূপুর মণি বাজয়ে কিঙ্কিণী
রাস রসে রতিরণে কী মধুর শুনি
জোড়া মৃদঙ্গ বেজে উঠল ‘ধ্রুব তালে’। নবদ্বীপের বৈষ্ণব ভজনকুটির বা আখড়াগুলিতে এ ভাবেই পালিত হয় রাস।

রাসে শক্তির আরাধনা
বলা হয় ‘রস’ থেকেই রাস। রস অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, হ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম বোঝায়। ‘তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে (২/৭) রস সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ। অর্থাৎ ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন। বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। আর পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ হলেন মধুর রসের ঘনীভূত আধার। তাঁকে ঘিরেই রাস। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য। যাকে বলা হয় ‘হল্লীবক” নৃত্য। কিন্তু বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটির ভিন্ন অর্থ বহন করে। শ্রীকৃষ্ণ শারদপূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের যমুনাতটে গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাদের অহং বর্জিত বিশ্বাসভক্তি ভাবে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব। এক অসামান্য আনন্দ উৎসব।

এহ বাহ্য। বৈষ্ণবদর্শনে রাসের যে ব্যাখ্যাই থাকুক না কেন, বৈষ্ণব আখড়ায় যে ভাবেই রাস পালিত হোক না কেন, শহর নবদ্বীপ, চৈতন্যজন্মভূমি নবদ্বীপে রাসের চেহারা ঠিক এর ‘বিপরীত’। পূর্ণিমার ভরা রাতে, বিশুদ্ধ তন্ত্রমতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো, সঙ্গে আদ্যন্ত তামসিকতায় ভরা এক দামাল উৎসবের উদযাপন— সংক্ষেপে এটই হল নবদ্বীপের রাসের সংজ্ঞা। পূর্ণিমার রাতে দেড়শোর বেশি বিরাট বিরাট শক্তিমূর্তির পুজোর কারণে নবদ্বীপের রাসকে অনেকে ‘শাক্ত রাস’ বলেও অভিহিত করেন।

নবদ্বীপের রাসের উৎস ঠিক কবে, এর উত্তরে স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক ও নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালে (১৭২৮-৮২) রাসের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল। রাজা হওয়ার পর থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত কৃষ্ণচন্দ্র নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন। তার পর থেকে তিনি মঠমন্দির স্থাপন, মেলা উৎসবের সূচনা বা বহু জনকল্যাণমূলক কাজে মনোনিবেশন করেন। ১৭৫৩-৫৬-র মধ্যে তিনি জগদ্ধাত্রীপুজো, বারোদোলের সূচনা করেন। মনে করা হয় ওই একই সময়ে তিনি নবদ্বীপে বৈষ্ণবদের রাস উৎসবের খোলনলচে বদলে দেন। শান্তিরঞ্জনবাবু আরও বলেন, কৃষ্ণচন্দ্র নিজে ছিলেন শাক্ত। নদিয়া, অগ্রদ্বীপ, কুশদ্বীপ এবং উলা এই চারটি সমাজের সমাজপতি। তার রাজত্বে শুদ্ধাচারে শক্তিসাধনা হোক এটা তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন। পাশাপাশি তিনি পছন্দ করতেন না চৈতন্যদেবকে মঠে-মন্দিরে পুজো করা হোক। তিনি বৈষ্ণববিদ্বেষী ছিলেন না, কিন্তু চৈতন্যদেবকে যাঁরা অবতার বলে পুজো করতেন তাঁদের তিনি ঘোর অপছন্দ করতেন। চৈতন্যদেবের অনুগামীরা বেদবিধি ও ব্রাহ্মণ্যস্মৃতি মানতেন, এটাও কৃষ্ণচন্দ্রের আপত্তির কারণ ছিল। তিনি রাসপূর্ণিমার রাতে নবদ্বীপে শক্তিমূর্তি পুজোয় উৎসাহ দেওয়া শুরু করেন। রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে।

শ্রীকৃষ্ণের অষ্টসখীর নাম গুলো হচ্ছে
1.ললিতা
2.বিসাখা
3.চিত্রা
4.ইন্দুরেখা
5.চম্পকলতা
6.রঙ্গদেবী
7.তুঙ্গবিদ্যা
8.সুদেবী