অ- অ অ+
রংপুরে আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক ওরফে বাবুসোনা কথিত নিখোঁজ হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে তাঁর লাশ উদ্ধার হয়েছে। নগরের তাজহাট বাবুপাড়ায় বাবুসোনার বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে তাজহাট মোল্লাপাড়া এলাকার নির্মাণাধীন একটি বাড়ি থেকে লাশ উদ্ধার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন—র্যাব।
লাশ উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাব-১৩-এর অধিনায়ক মেজর আরমিন রাব্বী জানিয়েছেন, রথীশের স্ত্রী তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দীপা ভৌমিকের সঙ্গে ওই স্কুলেরই সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলাম জাফরীর পরকীয়া ছিল। তারাই পরিকল্পনা করে রথীশকে হত্যা করেছে।
কোতোয়ালি থানার ওসি বাবুল মিয়া গতকাল সন্ধ্যায় জানান, এ ঘটনায় রথীশের ছোট ভাই সুশান্ত ভৌমিক গত ১ এপ্রিল অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছেন তাতে দীপা ও তার প্রেমিক কামরুল এবং তাদের সহযোগী সবুজ ও রোকনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
রথীশ হত্যাকাণ্ড নিয়ে নগরের স্টেশন এলাকায় গতকাল বুধবার দুপুরে র্যাব-১৩ কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পারিবারিক অশান্তি, বিদ্বেষ ও অবিশ্বাস থেকেই রথীশকে হত্যা করা হয়েছে। দুই মাস আগেই তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল দীপা ও কামরুল। তবে নানা কারণে সেটা তখন সম্ভব হয়নি।
র্যাব মহাপরিচালক জানান, আইনজীবী রথীশকে ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতেই তাঁর বাড়িতে হত্যা করা হয়। অথচ পরদিন শুক্রবার তাঁর স্ত্রী দীপা প্রচার করে যে ওই দিন সকাল ৬টার দিকে কাজের কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান তার স্বামী। এর পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁর ব্যবহৃত মুঠোফোনটিও বন্ধ। অথচ তদন্তে রথীশের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরটি পরীক্ষা করে র্যাব দেখেছে যে বৃহস্পতিবার রাতেও সেটি বন্ধ ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদে দীপা ও তার প্রেমিক কামরুলের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে র্যাব মহাপরিচালক জানান, ২৯ মার্চ রাতে আগে থেকেই রথীশের বাড়িতে লুকিয়ে ছিল কামরুল। পরে দীপা ভাত ও দুধের সঙ্গে ১০টি ঘুমের বড়ি খাওয়ায় রথীশকে। এরপর তিনি অচেতন হলে দীপা ও কামরুল ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে তাঁকে হত্যা করে। হত্যার পর তাঁর লাশ শোবার ঘরেই রাখা হয়। পরদিন শুক্রবার ভোর ৫টায় ওই বাসা থেকে বের হয়ে গিয়ে সকাল ৯টার দিকে একটি রিকশাভ্যান নিয়ে আসে কামরুল। পরে একটি আলমারিতে লাশ ভরে সেটি পরিবর্তনের নাম করে আলমারিটি নগরের তাজহাটের মোল্লাপাড়ায় কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন বাড়ির মেঝ খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। আলমারি বহনের জন্য তিনজনকে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল কামরুল।
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, মঙ্গলবার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রথীশের স্ত্রী দীপাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে আসে র্যাব। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাটি খুঁড়ে লাশটি উদ্ধার করা হয়।
বেনজীর আহমেদ জানান, বালু খোঁড়াখুঁড়ি ও লাশ লুকানোর সঙ্গে জড়িত থাকায় কামরুলের সাবেক দুই শিক্ষার্থী তাজহাট মোল্লাপাড়া এলাকার সবুজ ইসলাম ও রোকনুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ২৬ মার্চ কামরুলের নির্দেশে ৩০০ টাকার বিনিময়ে বালু খুঁড়ে রেখেছিল তারা। পরে তারা শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে ওই লাশ বালু দিয়ে গর্তে ঢেকে রাখে। কামরুল তাদের শিক্ষক হওয়ায় তারা আদেশ পালন করেছে বলে জানায়।
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, গ্রেপ্তারকৃতদের বিচারের মুখোমুখি করা। এ ব্যাপারে তদন্ত হবে। আর তখনই বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে জানা যাবে।’
ওই ব্রিফিংয়ে র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে মঙ্গলবার রাতে লাশ উদ্ধারের সময় র্যাব-১৩-এর অধিনায়ক মেজর আরমিন রাব্বী ঘটনাস্থলে ব্রিফিংয়ে জানান, রথীশের স্ত্রী দীপার দেওয়া তথ্যেই লাশ উদ্ধার হয়েছে।
ওই সময় রংপুর জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ও জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু, নিহত রথীশের ছোট ভাই সুশান্ত ভৌমিক, ভগ্নিপতি অধ্যাপক ডা. অনিমেষ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
যেভাবে লাশ উদ্ধার : র্যাব জানায়, মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে রথীশের স্ত্রী দীপাকে তাদের বাসা থেকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে দীপা স্বীকার করে যে সে এবং তার প্রেমিক কামরুল পরিকল্পনা করে স্বামীকে হত্যা করেছে। স্বামীর লাশ তাজহাট মোল্লাপাড়া এলাকায় কামরুলের বড় ভাই খাদেমুল ইসলাম জাফরীর নির্মাণাধীন বাসায় পুঁতে রাখা হয়েছে। পরে দীপা ও কামরুলকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাসায় গিয়ে মাটির নিচ থেকে বস্তাভর্তি লাশ উদ্ধার করে র্যাব। রথীশের ভাই সাংবাদিক সুশান্ত ভৌমিক লাশটি তাঁর ভাইয়ের বলে শনাক্ত করেন।
শুরুর ঘটনা : গত শুক্রবার আইনজীবী রথীশ নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তাল হয়ে ওঠে রংপুর। তাঁকে উদ্ধারের দাবিতে আইনজীবীসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলো মানববন্ধন, বিক্ষোভ, গণ-অনশনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
অ্যাডভোকেট রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনা রংপুর আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সহসাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক। এ ছাড়া হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রংপুর বিভাগের ট্রাস্টি, পূজা উদ্যাপন পরিষদ রংপুর জেলার সভাপতি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। আর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষী এবং রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি ও মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন তিনি।
এ কারণে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে জামায়াতে ইসলামী কিংবা জঙ্গিগোষ্ঠী বাবুসোনাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া নগরের ডিমলা রাজ দেবত্তোর স্টেট নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছিল। এ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় হওয়া মামলার বাদী ছিলেন বাবুসোনা। জমির অবৈধ দখলদাররা বাবুসোনাকে ধরে নিয়ে গেছে বলেও ধারণা ছিল অনেকের। তবে র্যাবের অভিযানে বেরিয়ে আসে অন্য তথ্য।
ঘটনার মোড় পাল্টায় যেভাবে : সোমবার তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলাম জাফরী ও মতিয়ার রহমানকে আটকের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ওই দিন সন্দেহভাজন ৯ জনকে আটকের পর কামরুল জাফরী ও মতিয়ারকে আটক করা হলেও তখন কিছু জানায়নি পুলিশ। পরদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাদের আটকের কথা নিশ্চিত করেন কোতোয়ালি থানার ওসি বাবুল মিঞা।
পরিবারে শান্তি ছিল না : আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিক ছিলেন নগরের শতবর্ষী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি। সেই সুবাদে তাঁর স্ত্রী দীপা ভৌমিক সহকারী শিক্ষক হিসেবে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি পায় বলে নিশ্চিত করেন প্রধান শিক্ষক তৌহিদা খাতুন। সেখানেই দীপা পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে সহকর্মী কামরুল ইসলাম জাফরীর সঙ্গে। কামরুলের বাড়ি তাজহাট মোল্লাপাড়ায় হলেও সে থাকে নগরের রাধাবল্লভ এলাকায়।
রথীশচন্দ্র ভৌমিকের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে দীপার পরকীয়ার কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হতো। এ নিয়ে অশান্তি ছিল পরিবারে। বিষয়টি নিয়ে অনেকবার পারিবারিকভাবে সালিসও হয়; কিন্তু তার পরও পরকীয়া থেকে ফেরানো যায়নি দীপাকে।
রথীশচন্দ্রের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। মেয়ে রংপুরের একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ঘটনার রাতে ছেলে ঢাকায় এবং মেয়ে তার ফুফুর (পিসি) বাড়িতে ছিল।
তিন দিনের শোক : আইনজীবী রথীশচন্দ্র ভৌমিকের লাশ উদ্ধারের পর গতকাল কর্মবিরতি পালন করেন রংপুরের আইনজীবীরা। এ ছাড়া আগামী তিন দিনের শোক ঘোষণা করেছে আইনজীবী সমিতি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রংপুর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক।
প্রতিক্রিয়া : রংপুর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক বলেন, ‘আমার সহকর্মী রথীশচন্দ্র ভৌমিক হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। যেন কেউ আর এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে সাহস না পায়।’
রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু বলেন, ‘রথীশচন্দ্র ভৌমিক জেলা আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দাবি জানাই, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।’
নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের পিপি জাহাঙ্গীর হোসেন তুহিন বলেন, ‘তিনি (রথীশ) একজন ভালো মানুষ ছিলেন। এ ধরনের হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়া যায় না।’
রথীশের ছোট ভাই সুশান্ত ভৌমিক বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’
রথীশের শেষকৃত্য সম্পন্ন : রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্তের পর রথীশচন্দ্র ভৌমিকের মরদেহ গতকাল বিকেলে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। এরপর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রংপুর আইনজীবী ভবন চত্বরে। সেখানে আইনজীবীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে এক ঘণ্টার জন্য মরদেহ রাখা হয়। সর্বস্তরের মানুষ সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সন্ধ্যায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তাজহাট বাবুপাড়ায় তাঁর নিজ বাড়িতে। এ সময় সেখানে আত্মীয়-স্বজনসহ শুভাকাঙ্ক্ষীরা ভিড় করে। ধর্মীয় রীতিনীতি পালন শেষে রাতে নগরের দখিগঞ্জ শ্মশানে তাঁর শেষকৃত অনুষ্ঠিত হয় বলে জানিয়েছেন ছোট ভাই সুশান্ত ভৌমিক।
আইনমন্ত্রীর শোক : অ্যাডভোকেট রথীশচন্দ্র ভৌমিক বাবুসোনার মৃত্যুতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক শোকবার্তায় আইনমন্ত্রী বলেন, ‘রথীশচন্দ্র ভৌমিক ছিলেন একজন নির্ভীক আইনজীবী। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে এবং দক্ষতার সঙ্গে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যা মামলার প্রধান আইনজীবী হিসেবে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এবং দ্রুততম সময়ে মামলা নিষ্পত্তিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন।’
আইনমন্ত্রী শোকবার্তায় রথীশচন্দ্রের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।