২৯/০৬/২০১৫ কেউ পছন্দ করুক আর না করুক পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম নেই। তারা সব সময় বাংলাদেশের সমালোচনা করেন। সর্বশেষ ১৭ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। এই সমালোচনা নতুন কিছু নয়। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ির আখ্যা দিয়েছিলেন। নেতিবাচক দৃষ্টান্তের জন্য পদ্মা সেতুর তহবিল বাতিল করেছিল বিশ্ব ব্যাংক।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টর ১৭ জুনের আলোচনায় বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়ার স্বাধীনতা, বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোর নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি, র্যাবের ক্রস ফায়ার, যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। আলোচনায় জিম ফিসপেট্রিক, জেরিমি করভিন, মার্টিন, বব ব্ল্যাক ম্যানসহ ২০ জন সংসদ সদস্য অংশ নেন।
সুশাসন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশকে ২৫০ মিলিয়ন পাউন্ড তহবিল দিয়ে থাকে বৃটেন। এছাড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যত ও বর্তমান রাষ্ট্রপরিচালনা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ব্রিটিশ সংসদ সদস্যরা। বাংলাদেশের জন্য এই বিতর্কটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সমালোচনাটি দেশের বৃদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের চোখ খুলে দিতে পারত। কি দুর্ভাগ্য আামদের বাংলাদেশের কোন গণমাধ্যমে এ নিয়ে কোন প্রকার আলোচনাই হয়নি।
বাংলাদেশের প্রবাসীরা ওই বিতর্কে গ্যালারীতে দর্শক হয়ে বসে থাকে। হাউজ অব কমন্সের দীর্ঘ বিতর্কে ২০ জন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। বৃটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্সে দীর্ঘ সাড়ে ৩ ঘন্টার বিতর্ক চলে বাংলাদেশকে নিয়ে। আলোচনার সূত্রপাত করেন বাংলাদেশ বিষয়ক অল পার্টি পার্লামেন্ট বিষয়ক চেয়ারম্যান অ্যান মেইন।
অতীত থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা কোন শিক্ষা নেয়নি বলে তিনি জানান। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রাদায়ের উপর হামলার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে মেইন বলেন, কোন সরকারই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। বাংলাদেশের দুর্নীতির চিত্র উল্লেখ করে মেইন বলেন, বাংলাদেশ বিনির্মাণে তহবিলকে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কার্যকরি করতে তিনি বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান করেন। বাংলাদেশে ৪৫ শতাংশ নীচে নেমে গেছে বলে তিনি জানান। দেশটিতে ৭৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করছে। মাথাটিছু আয় প্রতিদিন গড়ে মাত্র ২ মার্কিন ডলার। আয় ও সামাজিক জীবনের কোন স্থিতিশীলতা নেই বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে দুর্নীতি এখনো বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ ব্রিটিশদের সহায়তার ৩৪ শতাংশ প্রকল্পই চালাতে দেখা যায়নি। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বপ্ন ছিল তা ভাঙ্গনের চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলাদেশে। পরিহার্য দুর্ঘটনায় শতশত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে পোশাক কারখানায়। চট্টগ্রামের জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে প্রতিদিন ৩/৪জন শ্রমিক প্রাণ হারাচ্ছে। বাংলাদেশ শ্রমিকদের কাজ করার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পরিবেশ বিরাজ করছে।
একজন ব্রিটিশ সংসদ সদস্য বাংলাদেশের সুশাসন, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, স্বচ্ছতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি, বাল্য বিয়ে, শিশুশ্রম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ৬৫ শতাংশ বাংলাদেশি তরুণীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই আর ২৯ ভাগ তরুণীর আগেই বিয়ে হয় ১৫ বছরের তরুণীর।
জিম ফিসট্রিক বলেন, বাল্য বিয়ের পছন্দের জন্যই তারা দারিদ্রতার মধ্যে পড়ে । বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ। ৪৩ শতাংশ নাগরিকের বয়স ৩০ বছরের নীচে। সম্প্রতি বাংলাদেশের রানাপ্লাজা ও তাজরীন ফ্যাশন বিপর্যয়ের মাধ্যমে ১ হাজার ২’শ পোশাক শ্রমিক প্রাণ হারানোর জন্য একাধিক এমপি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। হুগো সুইয়ার বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের মানুষের ভোটের প্রতিফলন ঘটেনি। এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। ৯২ মিলিয়ন ভোটারের মধ্যে মাত্র ৪৬ মিলিয়ন ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে যা কখনো গণতন্ত্রের সঙ্গার মধ্যে পড়ে না। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি করেন তিনি। বাংলাদেশের সর্বশেষ সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনেও ব্যাপক সহিংতা হয়েছে যা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে বলে তিনি জানান।
জামায়াতে ইসলাম সম্পর্কে ব্রিটিশ সংসদ জিম আরো বলেন, ‘ ইউরোপের ইসলামিক ফোরামের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলাম। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকার নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। জামায়াত এক সময় আওয়ামী লীগের সহযোগি ছিল।’ সংসদ সদস্য কেরি ম্যাককার্টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্ভাস্তুদের মানসিক রোগি বলার জন্য তীব্র সমালোচনা করে বলেন সাগরে ভাসমানদের মানসিক রোগি আখ্যা দেওয়া দেশের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়।
বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুঁড়ি নয়। বাংলাদেশ গত দুই দশকে ভারতের চেয়েও সামাজিক সূচকে এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আন্তজার্তিক উন্নয়নশীল এজেন্সির সহায়তায় দরিদ্রদূরীকরণ, স্বাস্থ্যসেবা, শিশুমৃত্যু হার, নারী শিক্ষার প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়ে আছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন জানিয়েছেন বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে সামাজিক সূচক, লিঙ্গ সমতা ও মানবিক উন্নয়ন সূচকেও অনেক এগিয়ে আছে।
জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১৯৪৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার চেয়েও মাথাপিচু আয় অনেক বেশি ছিল বাংলাদেশের। পূর্ব বাংলা থেকে শুধু জাপান ও সিঙ্গাপুর এগিয়ে ছিল। বাংলাদেশি রাজনীতিবিদ, গবেষক, বুদ্ধিজীবীরা এ বিতর্ক থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের অর্জন সম্পর্কে গৌরব অর্জন করতে পারে। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্রাকসহ এনজিওগুলোর অবদান অসামান্য। নিজের দেশের প্রকৃত অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক সূচক উপলব্ধি করতে হবে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টর ১৭ জুনের আলোচনায় বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়ার স্বাধীনতা, বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোর নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি, র্যাবের ক্রস ফায়ার, যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে উঠে আসে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা বাংলাদেশ কিভাবে এগিয়ে যাবে সে বিষয়ে কিছুই বলেননি। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের এ ভ্রান্ত বিতর্ক নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় যা করণীয় তা এই বিতর্ক থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
লেখক: অস্ট্রিন পিয়ে স্টেট ইউনির্ভাসিটির সিকিউরিটিস স্টাডিসের শিক্ষক