ঢাকা, এপ্রিল ২০, ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১০:০৬:০৮

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র পুনর্বাসন না করে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা হবে না: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি হিসেবে ফের নিয়োগ পেলেন বিপ্লব বড়ুয়া সংসদ অধিবেশন উপলক্ষে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ আপিলে দ্বিতীয় দিনে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ৫১ জন নির্বাচনে ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনী চায় ইসি : পিএসও আদালত আবমাননায় বিচারক সোহেল রানার সাজার বিরুদ্ধে আপিলের রায় ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর ২১টি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৪ জন গ্রেফতার : ডিএমপি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কিনা, জানালেন ইসি

আট জেলায় ধর্ষণের শিকার নারীদের সরকারি আইনি সহায়তার হালচাল

| ২৬ ভাদ্র ১৪২৪ | Sunday, September 10, 2017

marital-rape_final-1

ধর্ষণের ঘটনায় ১৬ বছরে সরকারের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার ৪ হাজার ৫৪১টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ৬০টি ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়েছে। পুলিশ থেকে শুরু করে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো ঠিকমতো কাজ করছে না বলে ঘটনা প্রমাণ করা কঠিন হচ্ছে। ঘটনার শিকার অধিকাংশ নারী বিচার পাচ্ছেন না।

সরকার ২০০১ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনা, রংপুর ও ফরিদপুর জেলায় ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) চালু করে। সেন্টারগুলোর মাধ্যমে এই আটটি জেলায় ধর্ষণের শিকার নারীরা আইনি সহযোগিতা পান। ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই সেন্টারগুলো থেকে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের পক্ষে ৪ হাজার ৫৪১টি মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে ১ হাজার ২২৯টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তি হওয়া মামলার মধ্যে ৬০টিতে দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পেয়েছে। অন্যদিকে ৩ হাজার ৩১২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। নিষ্পত্তি না হওয়া মামলা ৭৩ শতাংশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ধর্ষণের বিচারের জন্য সরকারের যে কটি পক্ষ জড়িত, তার কোনোটিই ঠিকভাবে কাজ করছে না। একই মন্তব্য করেছেন ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, সারা দেশে গত বছর ৩ হাজার ৬৪৮ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ২০১২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৭০০, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৮৯১, ২০১৪ সালে ৩ হাজার ৬৪৭ ও ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৬২২। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঘটনার তুলনায় মামলা কম হয় আর মামলা হলেও নিষ্পত্তি হয় অনেক কম।

বিচার চাইতে গেলে চরম লাঞ্ছনা

পরিবার ও সমাজের চাপে নারীরা ধর্ষণের কথা বলতে চান না। ধর্ষণের দায় নারীদের ওপর চাপানো হয় বলে অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েও চুপ থাকেন। আবার ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চাইতে গেলে চরম লাঞ্ছনার মুখোমুখি হতে হয়। ২০১২ সালে ঢাকায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছিলেন এক নারী। গত মঙ্গলবার তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘটনাস্থল হাজারীবাগ না লালবাগ, সে নিয়েই প্রথমে আমাকে দ্বিধায় ফেলে দেয় পুলিশ। আট ঘণ্টা চেষ্টার পর আমি হাজারীবাগ থানায় মামলা করি। পুলিশ আমাকে বলে, মামলা করতে ছবি তুলতে হবে। আমি একটু অস্বস্তি বোধ করছিলাম। পুলিশ তখন টিপ্পনী কেটে বলে, ধর্ষণের মামলা করতে শরম লাগে না, আর ছবি তুলতে শরম?’ ওই নারী তারপরও পরিবারের সহযোগিতা নিয়ে মামলা চালিয়ে যান। প্রকাশ্য আদালতে বহু মানুষের সামনে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাঁকে বলেন, যৌনকর্ম ওই নারীর পেশা। কিন্তু এই অভিযোগ ছিল অসত্য।

অনেক সময় অতি আপনজনও নারীর পাশে দাঁড়ান না। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের চালকেরা ১৪ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ করে। ঘটনাস্থল থেকে এলাকার লোকজন একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশে দেয়। মেয়েটি পুলিশের জিম্মায়। তার বাবা তাকে দেখতে যাননি। কেন যাননি জানতে চাইলে ওই বাবা বলেন, এলাকায় তাঁর বদনাম হয়ে গেছে। মেয়েকে নিয়ে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

যে কারণে বিচার হয় না

ধর্ষণের বিচারপ্রক্রিয়ার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। কেউ ধর্ষণের শিকার হলে কী করবেন, সে পরামর্শ পেতে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টারে ১০৯ ডায়াল করে সাহায্য চাইতে পারেন। সেখান থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনি থানায় যাবেন। নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তা ‘সহমর্মী’ হবেন এবং থানা নারীবান্ধব পরিবেশে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুকে সহযোগিতা করবে। পুলিশের সহযোগিতায় ধর্ষণের শিকার নারী (বা শিশু) ডাক্তারি পরীক্ষা করাবেন। নির্দিষ্ট সময়ে অভিযোগপত্র জমা দেবে পুলিশ। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ হবে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অন্য রকম।

ধর্ষণের বিচার না হওয়ার কারণ খুঁজতে মহিলা ও শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, পুলিশ ও রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির সঙ্গে কথা হয়। প্রতিটি পক্ষ অন্য পক্ষকে দোষারোপ করেছে। মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মামলা প্রমাণ করা যাচ্ছে না বলে বিচার হচ্ছে না। ধর্ষণের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে আলামত খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে সম্পর্কে সবাই জানেন না। কেউ ধর্ষণের শিকার হলে ১০৯ নম্বরে ডায়াল করে কী করতে হবে, সে সম্পর্কে জানতে পারেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টাঙ্গাইলে রুপা নামের যে মেয়েটি চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হয়ে খুন হয়েছেন, তিনি একা বাসে যাওয়ার কথা জানিয়ে ১০৯-এ একটা ফোন করতে পারতেন। তাঁকে সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব হতো।

তবে গত মঙ্গলবার এ প্রতিবেদক ১০৯ নম্বরে ফোন করলে একজন কর্মকর্তাকে ফোনে পেতে সময় লেগেছে সাড়ে ৮ মিনিট। অপর প্রান্ত থেকে যিনি কথা বলেছেন, তাঁর কথাও পরিষ্কার শোনা যায়নি।

সংবেদনশীল আচরণ না করার অভিযোগ

এ ছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে সংবেদনশীল আচরণ না করার অভিযোগ আছে। থানায় মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে পুলিশ কী করে, এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সব থানায় ২৪ ঘণ্টার জন্য নারী কর্মকর্তা নেই। ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে প্রথমেই ডিউটি অফিসারের মুখোমুখি হতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই ডিউটি অফিসার হন পুরুষ। প্রায়ই পুলিশ আক্রান্ত নারীর উদ্দেশে ‘২৯০’ কথাটা উচ্চারণ করেন। সাধারণত অবৈধ যৌনকর্মের জন্য যাঁরা গ্রেপ্তার হন, তাঁদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২৯০ ধারায় মামলা করে থাকে পুলিশ।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি মাহমুদা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পুলিশ সময়মতো সাক্ষী হাজির করতে পারছে না। ডাক্তারি রিপোর্টও ঠিকমতো পাওয়া যায় না। এই করে করেই মামলার পাহাড় জমেছে।’

এ বিষয়ে জানতে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম) মো. মহসিন হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন

থানা থেকে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুকে নেওয়া হয় ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য। বাংলাদেশ মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটির সভাপতি এ এম সেলিম রেজা বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার নারী শিশু ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য আসছেন অনেক দেরি করে। আলামত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কী কী করলে আলামত নষ্ট হয়, সে সম্পর্কে সবাই সচেতন নন। তা ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণকারীরও স্বাস্থ্যপরীক্ষার বিধান আছে। ধর্ষণের শিকার হওয়ার সময় একজন নারী সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন নিজেকে বাঁচাতে। সে ক্ষেত্রে ধর্ষণকারীর শরীরে চিহ্ন থাকবে। ডিএনএ নমুনা ধর্ষণের শিকার নারী ও ধর্ষণকারী—দুজনের শরীরেই থাকার কথা। তা ছাড়া ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’ নিয়েও অনেকের মধ্যে ভীতি আছে।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সঙ্গে কাজ করছেন ফারজানা শুভ্রা নামের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক। তিনি টু ফিঙ্গার্স টেস্ট ও সাক্ষ্য আইন: ১৫৫(৪)-এর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্টে’ একজন চিকিৎসক নারীর যোনিপথে হাত ঢুকিয়ে দেখেন তাঁর সতীচ্ছদটি ছিঁড়েছে কি না। যদি আগে থেকেই ছেঁড়া থাকে, তাহলে ডাক্তারি প্রতিবেদনে লেখা হয় ‘যৌনকর্মে অভ্যস্ত’। এই মন্তব্য আসামিপক্ষের আইনজীবীরা কাজে লাগান। অন্যদিকে ১৫৫(৪)-এ বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার বা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যাইতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।’ অপরাধ প্রমাণের দায় ধর্ষণের শিকার নারীর ওপর বর্তায়। ভারতে ২০০৩ সালে এই বিধির পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশে এখনো জারি আছে।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী গত বুধবার গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথমত ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে। ঢাকাসহ কয়েকটি মেডিকেল কলেজের বাইরে এই বিভাগের অবস্থা খুবই করুণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদন আসছে। পুলিশের সংবেদনশীলতা দরকার। আর ধর্ষণের মামলাগুলোর অগ্রগতি নিয়ে সরকারের নজরদারির প্রয়োজন।

-প্রথম আলো