ঢাকা, এপ্রিল ২৫, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, স্থানীয় সময়: ১৫:২৫:১৬

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

টেলিভিশন ও অনলাইন সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দাবি বিএফইউজে’র পুনর্বাসন না করে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা হবে না: তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারি হিসেবে ফের নিয়োগ পেলেন বিপ্লব বড়ুয়া সংসদ অধিবেশন উপলক্ষে সংসদ ভবন ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ আপিলে দ্বিতীয় দিনে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ৫১ জন নির্বাচনে ২৯ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনী চায় ইসি : পিএসও আদালত আবমাননায় বিচারক সোহেল রানার সাজার বিরুদ্ধে আপিলের রায় ২৩ জানুয়ারি রাজধানীর ২১টি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৪ জন গ্রেফতার : ডিএমপি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন হবে কিনা, জানালেন ইসি

আটক স্বর্ণ যায় কোথায়

| ১২ পৌষ ১৪২১ | Friday, December 26, 2014

আটক স্বর্ণ যায় কোথায়    

বিমানের টয়লেট, সিটের নিচ বা যাত্রীর কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে আনা স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর মালিককে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে এসব স্বর্ণ যায় কোথায় কিংবা কারা এর ক্রেতা, তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল রয়েছে।

ওবায়দুল্লাহ রনিবিমানের টয়লেট, সিটের নিচ বা যাত্রীর কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে আনা স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনা প্রায়ই শোনা যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর মালিককে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে এসব স্বর্ণ যায় কোথায় কিংবা কারা এর ক্রেতা, তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চোরাপথে আটক সব স্বর্ণই প্রথমে জমা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। কেউ মালিকানা দাবি না করলে সরাসরি তার মালিক হয়ে যায় সরকার। দাবিদার থাকলে আদালতের নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট চার হাজার ১৬০ কেজি বা ১০৪ মণ স্বর্ণ ধরা পড়েছে শুল্ক গোয়েন্দাদের হাতে। দাবিদার পাওয়া যায়নি এমন ৫৩ মণ যোগ হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের কাছ থেকে তা কিনেছে। মামলায় ঝুলে আছে সাড়ে ২৩ মণ স্বর্ণ। এর বাইরে কিছু স্বর্ণ নিলামে বিক্রি করেছে সরকার। কিছু স্বর্ণ আদালতের নির্দেশে শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে দাবিদারদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছে।

২০১১ সালে সরকারের এক তদন্তে দেখা যায়, দেশে চাহিদার প্রায় সবই পূরণ হয় চোরাপথে আসা স্বর্ণের মাধ্যমে। চোরাই স্বর্ণের খুব কমই ধরা পড়ে। শুল্ক গোয়েন্দারা মনে করেন, চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে বিভিন্ন সময় বহনকারী বা বিমানের কেবিন ত্রুক্র ধরা পড়লেও মূল হোতারা থেকে যায় আড়ালে। বিমানের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় এসব স্বর্ণ নিয়ে আসে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, অবৈধভাবে আসা স্বর্ণের চালান যেখানেই ধরা পড়ূক, তা জমা করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকে। এ ক্ষেত্রে স্বর্ণ মালিকবিহীন অবস্থায় ধরা হলে সরাসরি তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্থায়ী খাতে জমা হয়। আর মালিকানার দাবিদার থাকলে আদালতের নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখান থেকে আন্তর্জাতিক মানসম্মত স্বর্ণবার কিনে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে জমা করা হয়। বাকি স্বর্ণবার বা অলঙ্কার নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। সব টাকা জমা হয় সরকারি কোষাগারে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকে স্বর্ণ বা মূল্যবান সামগ্রী সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকায় তা এখানে আনা হয় ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নভেম্বরভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতা-পরবর্তী এ পর্যন্ত আটক করা স্বর্ণের মধ্যে প্রায় ৯৬ মণ হলো স্বর্ণবার। বাকি আট মণ স্বর্ণালঙ্কার। এসব স্বর্ণবারের মধ্যে দুই হাজার ১১২ কেজি বা প্রায় ৫৩ মণ স্বর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিয়েছে। সমসাময়িক আন্তর্জাতিক বাজারদরের আলোকে নির্দিষ্ট দামে এসব স্বর্ণ কেনা হয়। সর্বশেষ গত ১১ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনেছে ২৪৩ কেজি বা ছয় মণের সামান্য বেশি স্বর্ণ। এর আগে চলতি বছরের ২৯ জুন কেনা হয়েছিল ২৫ কেজি স্বর্ণ। রিজার্ভের জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্মত প্রথম শ্রেণীর স্বর্ণবার কিনে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ পর্যন্ত আটক করা স্বর্ণবারের বেশির ভাগই প্রথম শ্রেণীর।রিজার্ভে নেওয়া স্বর্ণবারের বাইরে এখন ৯২৯ কেজি বা সাড়ে ২৩ মণ স্বর্ণবার বাংলাদেশ ব্যাংকের অস্থায়ী খাতে জমা আছে। এসব স্বর্ণের বিপরীতে মামলা থাকায় এখনও এর মালিক কে হবে, তা নির্ধারিত হয়নি। আর ৮৩৯ কেজি বা প্রায় ২১ মণ স্বর্ণবার বিভিন্ন সময়ে নিলামে বিক্রি বা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী খাতে রাখা হয়েছে দুই কেজি স্বর্ণবার। দেশ স্বাধীনের পর থেকে আটক স্বর্ণালঙ্কারের মধ্যে এ পর্যন্ত বিক্রি বা ফেরত দেওয়া হয়েছে ২৫২ কেজি বা সাত মণ ১৫ কেজি। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের স্থায়ী খাতে এখন ১২ কেজি ও অস্থায়ী খাতে ২২ কেজি স্বর্ণ জমা আছে।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় স্বর্ণের চোরাচালান ধরা পড়ে ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। গত বছরের ২৩ জুলাই নেপাল থেকে আসা একটি বিমান থেকে ১২৪ কেজি ২১৬ গ্রাম স্বর্ণ আটক করা হয়। স্বর্ণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চোরাচালানটি ধরা পড়েছে এ বছরের ২৬ এপ্রিল। দুবাই থেকে আসা একটি বিমানের টয়লেট থেকে ১০৫ কেজি স্বর্ণ আটক করে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় চোরাপথে আসা স্বর্ণের চালান ধরা পড়ার ঘটনা বেড়েছে। ১০৫ কেজি স্বর্ণের চালানটি ধরা পড়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় এনবিআরের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেন জানিয়েছিলেন, পার্শ্ববর্তী দেশে স্বর্ণ আমদানিতে শুল্কহার বেশি হওয়ায় চোরাকারবারিরা বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে। এর পর গত জুনে চলতি অর্থবছরের জন্য ঘোষিত বাজেটে বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করা স্বর্ণবারে আগের চেয়ে ২২ গুণ বেশি শুল্ক আরোপ করেছে সরকার।প্রাপ্ত তথ্যমতে, আটক স্বর্ণ বিক্রি করতে নিলাম ডাকা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের একজন করে প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটি এ জন্য নিলাম ডাকে। স্বর্ণ চোরাচালান বাড়লেও দীর্ঘ সময় ধরে স্বর্ণ বিক্রির নিলাম হচ্ছে না। সর্বশেষ নিলামটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই, যেখানে ২১ কেজি ৮২২ গ্রাম স্বর্ণ বিক্রি করা হয়েছিল। ধরা পড়া স্বর্ণের বেশির ভাগই আন্তর্জাতিক মানসম্মত স্বর্ণবার হওয়ায় তা বাইরে বিক্রির প্রয়োজন হয়নি। এ কারণে নিলামও ডাকা হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের মহাব্যবস্থাপক।বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ২০১১ সালে পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈধ উপায়ে কোনো স্বর্ণ আমদানি হয় না। দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ থেকে একশ্রেণীর চোরাকারবারির সহায়তায় স্বর্ণ এনে তা এখানকার বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে বিপুল রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। পরিস্থিতির উন্নয়নে আমদানি নীতিমালা সহজীকরণ, স্বর্ণশিল্পের জন্য নীতিমালা ঘোষণাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক খান সমকালকে বলেন, দেশের কোনো স্বর্ণ ব্যবসায়ী চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত নয়। স্বর্ণ ব্যবসা আর চোরচালান একসঙ্গে চলে না। আজ পর্যন্ত কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এ ধরনের কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তিনি আরও জানান, প্রবাসী বা বিদেশ ভ্রমণ থেকে ফেরার সময় বৈধ উপায়ে প্রতিদিন ৩০-৪০ কেজি স্বর্ণালঙ্কার দেশে আসছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বা তারও আগ থেকে আসা এভাবে বর্তমানে দেশে লাখ লাখ কেজি স্বর্ণ রয়েছে। জরুরি প্রয়োজন বা অন্য কোনো কারণে কেউ না কেউ প্রায় প্রতিদিনই কিছু স্বর্ণ বিক্রি করেন। ব্যবসায়ীরা যা কিনে পরিশুদ্ধ করে অন্যদের কাছে বিক্রি করেন।

বিদ্যমান আইনে বাংলাদেশে ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে আমদানির বিধান থাকলেও এলসির বিপরীতে ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ আনেন না। কেননা, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ঘণ্টায় স্বর্ণের দাম ওঠানামা করে। ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে স্বর্ণ আমদানি করতে গিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণে দামে অনেক হেরফের হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বর্তমানে বৈধপথে একমাত্র ব্যাগেজ রুলের আওতায় নির্ধারিত পরিমাণ স্বর্ণ দেশে আসে। তবে এর পরিমাণ খুবই কম। আর এ ব্যাগেজ রুলে আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং এনবিআরের আইনে ভিন্নতা রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে, একজন যাত্রী নির্ধারিত হারে শুল্ক পরিশোধ করে বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ দুই কেজি স্বর্ণবার আনতে পারেন। এ বৈষম্য দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বিদ্যমান নীতিমালা সংশোধনে কাজ করছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ত্রুক্র মাজহারুল আফসার রাসেলকে গত ১২ নভেম্বর দুই কেজি ৬০০ গ্রাম স্বর্ণসহ গ্রেফতার করা হয়। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে বিমানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নাম বের হয়ে আসে। এর পর স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ নভেম্বর বিমানের চেয়ারম্যানের কথিত ‘ধর্মপুত্র’ মাহমুদুল হক ওরফে পলাশ, বিমানের চিফ অব প্ল্যানিং অ্যান্ড সিডিউলিং ক্যাপ্টেন আবু মো. আসলাম শহীদ, সিডিউলিং ম্যানেজার মো. তোজাম্মেল হোসেন, ফ্লাইট সার্ভিস শাখার ডিজিএম এমদাদ হোসেন ও হারুন অর রশিদ নামের এক মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে এর আগে বিভিন্ন সময়ে বিমানের অনেক কর্মী গ্রেফতার হলেও ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা গ্রেফতারের ঘটনা ছিল এই প্রথম। এ ছাড়া যারা মূলত এসব স্বর্ণ আনান, বরাবরই তারা আছেন আড়ালে।