ঢাকা, মার্চ ২৯, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, স্থানীয় সময়: ০২:৫২:৩৪

এ পাতার অন্যান্য সংবাদ

কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট শিশুদের নতুন করে বাঁচার পথ খুলে দেয় : সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ভাসানচর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরণ: মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫ আসন্ন পবিত্র রমজানে সরকারিভাবে বড় ইফতার পার্টি না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে নিঃস্বার্থ সেবা দেয়ার নির্দেশ রাষ্ট্রপতির পণ্যমূল্য সহনীয় রাখতে সরকারের পাশাপাশি জনগণেরও নজরদারি চাই : সংসদে প্রধানমন্ত্রী রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে : প্রধানমন্ত্রী দিনের তাপমাত্রা বাড়তে পারে বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের ও উপনেতা আনিসুল ইসলাম রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার ওপর গুরুত্বারোপ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় আসার নিশ্চয়তা না পেয়ে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে : প্রধানমন্ত্রী

আগামী ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী শিব চতুর্দশী মেলা

| ২৫ মাঘ ১৪২৪ | Wednesday, February 7, 2018

৩০০ বছরের শিব চতুর্দশী মেলা

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে চন্দ্রনাথ ধামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শিব চতুর্দশী মেলার প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে। আগামী ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী এ মেলা অনুষ্ঠিত হবে। মেলায় প্রতিবছর দেশ-বিদেশের লাখো সনাতন তীর্থযাত্রীর সমাগম ঘটে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন : সৌমিত্র চক্রবর্তী, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম)

আনুমানিক ৩০০ বছরেরও আগে সীতাকুণ্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ ধামে শিব চতুর্দশী মেলা শুরু হয়। তবে এর সঠিক সময়কাল নির্ধারণ করা যায়নি। সনাতন ধর্মাবলম্বী ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি, মহাতীর্থের পুরোহিত, তীর্থ কমিটি ও মেলা কমিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, এখানে শিব চতুর্দশী মেলা শুরু নিয়ে নানান কাহিনি আছে। এ নিয়ে মতভেদও দেখা যায়। তবে যিনি বা যাঁদের উদ্যোগে মেলাটি প্রথম শুরু হোক না কেন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চন্দ্রনাথ ধাম সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ এ বিষয়ে সবাই একমত। এটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক সনাতন ধর্মাবলম্বী জীবনে একবার হলেও সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ ধাম মহাতীর্থ দর্শন করতে চান। ফলে সারাবছর এখানে বহু পুণ্যার্থীর আগমন হয়।

ফাল্গুন মাসের চতুর্দশী তিথিকে বলা হয় শিব চতুর্দশী। এই তিথিতে ভক্তি সহকারে পূজা করলে শিবঠাকুর (মহাদেব) ভক্তের প্রতি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। তাই এই তিথিতে শ্রদ্ধার সঙ্গে মহাদেবের পূজা করতে ও একই সুযোগে মহাতীর্থভূমির মঠ-মন্দিরগুলো দর্শন করে পুণ্যলাভের আশায় এখানে ছুটে আসেন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ সারাবিশ্বের হিন্দুরা। প্রতিবছর শিব চতুর্দশী তিথির আগে পরে অন্তত ১৫ দিন দর্শনার্থীদের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে সীতাকুণ্ড। এ সময় পুরো তীর্থভূমি সেজে ওঠে নতুন সাজে। সর্বত্র উৎসবের আমেজ দেখা যায়।

ভবানী ও কৃষ্ণ মন্দিরের পুজারী দীপক ভট্টাচার্য ও শম্ভুনাথ মন্দিরের পূজারী দীপক চক্রবর্তী বলেন, ‘সব তীর্থ দর্শনের পরও তীর্থদর্শন সম্পন্ন করতে হলে একবার হলেও চন্দ্রনাথ ধাম দর্শন করা আবশ্যক। তাই প্রত্যেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী এখানে ছুটে আসতে চান।’

চন্দ্রনাথে পৌঁছানোর পথ

তীর্থভূমি চন্দ্রনাথ ধামে যেতে হলে তীর্থযাত্রীদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যেকোনো বাসযোগে সীতাকুণ্ড পৌরসদর বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে। ঢাকা থেকে সীতাকুণ্ডের দূরত্ব ১৯৫ কিলোমটাির। আর চট্টগ্রাম থেকে ৩৭ কিলোমিটার। সীতাকুণ্ড পৌরসদর থেকে মন্দির সড়কের (কলেজ রোড) পিচঢালা পথে কিছুটা পূর্ব দিকে গেলেই বটতলী কালীবাড়ি থেকে তীর্থের মঠ-মন্দির শুরু। তবে প্রেমতলা এলাকার পরই বেশির ভাগ মঠ-মন্দিরের অবস্থান। এ পথে পাহাড় চূড়ায় সর্বশেষ মন্দির চন্দ্রনাথ মন্দিরের অবস্থান। বাস বা ট্রেন দুই পথেই এখানে যাতায়াত করা যায়। আর শিব চতুর্দশী মেলাকে ঘিরে এখানে প্রতিবছর বেশ কয়েকটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয় সরকারি উদ্যোগে। আবার সীতাকুণ্ডে আসার পর দুই পথে চন্দ্রনাথে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। যাত্রীরা মন্দির সড়ক হয়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠতে পারেন কিংবা বটতলী কালীবাড়ির সামনে থেকে ছোট গাড়িতে করে ইকোপার্ক হয়ে চন্দ্রনাথ দর্শন করে ওই পথে ফিরতে পারেন।

দর্শনীয় মঠ-মন্দির

সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ ধামে অসংখ্য মঠ-মন্দির রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বটতলী কালী মন্দির, শনি মন্দির, প্রেমতলা মন্দির, সত্যনারায়ণ মন্দির, শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রম, ব্যাসকুণ্ড, ভৈরব মন্দির, সূর্যকুণ্ড, শংকর মঠ ও মিশন, রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম, জগন্নাথ মন্দির, মোহন্ত আস্তানা, ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের সৎসঙ্গ, শ্মশান কালীমন্দির, হনুমান মন্দির, উনকোটি শিবেরবাড়ি, রামকুণ্ড, লক্ষ্মণ কুণ্ড, সীতাকুণ্ড, নারায়ণছত্র, সীতার পাতালপুরী, দধিকুণ্ড, জ্বালামুখী কালীবাড়ি, গুরুধ্বনি, অন্নপূর্ণা মন্দির, স্বয়ম্ভূনাথ মন্দির, বিরূপাক্ষ মন্দির ও পাহাড় চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির।

শিব চতুর্দশী তিথির পূজা-পার্বণ

দূরাগত তীর্থযাত্রীরা পুণ্যলাভের আশায় চন্দ্রনাথ ধামে উপর্যুক্ত মঠ-মন্দির দর্শন ও পূজা করেন। শিব চতুর্দশী তিথিতে ধর্মপ্রাণ হিন্দুরা এখানে ব্যাসকুণ্ডে পুণ্যস্নান করে মূলত ভৈরববাড়ি, শম্ভুনাথ বাড়ি, বীরুপাক্ষ ও চন্দ্রনাথ দর্শন করে দেবাদিদেব মহাদেবকে ডাবের জল ও দুধ দিয়ে স্নান করিয়ে মাথায় ফুল ও বেলপাতা দেন। পাশাপাশি অন্যান্য মঠ-মন্দির দর্শন করেন। তবে এই তিথিতে অনেকে ব্যাসকুণ্ডের পাড়ে পূর্ব পুরুষদের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধ, তর্পণ, গয়াকুণ্ডে পিণ্ডদানসহ নানান ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেন।

এবারের শিব চতুর্দশী তিথি

প্রতিবছর এখানে শিব চতুর্দশী মেলা অনুষ্ঠিত হয় ফাল্গুন মাসের চতুর্দশী তিথিকে কেন্দ্র করে। পঞ্জিকায় এ তিথি যে বছর যে সময়ে উল্লেখ করা হয় মেলাটিও অনুষ্ঠিত হয় সেসময়। সে হিসাবে এবারের শিব চতুদর্শী তিথি শুরু হবে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টা ১৮ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডে। ১৪ ফেব্রুয়ারি রাত ১টা ১২ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের পর এই তিথি ছেড়ে যাবে। ফলে অন্যান্য বছরের মতো এবারও এই তিথির একদিন আগে থেকে একদিন পর পর্যন্ত অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মূল মেলা অনুষ্ঠিত হবে। তিন দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে মেলা সমাপ্ত ঘোষণা করা হলেও দোলপূর্ণিমা পর্যন্ত (আরো ১৫ দিন) মেলার বেশ কিছু দোকানপাট থেকে যায়।

নানা আয়োজন

তিন দিনের শিব চতুর্দশী মেলা ঘিরে প্রতিবছর বেশ কিছু আয়োজন করে থাকে তীর্থ কমিটি ও মেলা কমিটি। মঠ-মন্দিরে পূজার্চ্চনা ছাড়াও তীর্থভূমির মোহন্ত আস্তানায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় ধর্মীয় আলোচনা সভা। এতে দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ অতিথি, মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকেন। থাকে দেশ-বিদেশ থেকে আগত সাধুদের নিয়ে নানান ধর্মীয় আয়োজন। এ সময় পুরো তীর্থভূমিতে সাধু-সন্ন্যাসীদের জপ-তপ, পূজা, শঙ্খধ্বনি, মহাপ্রসাদ বিতরণসহ নানান আয়োজনে তীর্থভূমি থাকে সরগরম।

মেলায় দোকানপাট

প্রতিবছর বিশাল এ মেলাকে ঘিরে পুরো তীর্থভূমিতে অসংখ্য দোকানপাট বসে যায়। এতে ধর্মীয় বই-পুস্তক, দেব-দেবতাদের ছবি, শিশু-কিশোরদের খেলনা, নানারকম খাবারের দোকান থেকে শুরু করে বহু দোকান বসে। অসংখ্য খাবার হোটেলে নিরামিষ রান্না করে বিক্রি করা হয়। দূরাগত দর্শনার্থীরা তীর্থদর্শন, খাওয়া দাওয়া, কেনাকাটা করে বাড়ি ফেরেন।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সহযোগিতা

উপমহাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান এই ধর্মীয় উৎসবকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে প্রতিবছর অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এগিয়ে আসে। কেউ তীর্থ যাত্রীদের বিনা মূল্যে পানীয় জল সরবরাহ করেন, কেউবা যাত্রীরা যেন নিরাপদে তীর্থ দর্শন করতে পারেন সে লক্ষ্যে পুরো সড়ক ও মন্দিরে নির্দিষ্ট পোশাকে দায়িত্ব পালন করেন। আবার মেলায় যাত্রীদের সুবিধার্থে প্রতিবছর আলোকসজ্জা, পানীয় জল প্রভৃতি সরবরাহ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও। এভাবে সবার সহযোগিতায় মেলা সুসম্পন্ন হয়।

কঠোর নিরাপত্তা

মেলা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে প্রতিবছরের মতো এবারও চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসককে সভাপতি করে মেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে কার্যকরী সভাপতি ও পলাশ চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করে ১০১ সদস্য বিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি প্রত্যক্ষভাবে মেলা পরিচালনা করবে। এ ছাড়া মেলার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবে পুলিশ, র‌্যাব, আনসারের সমন্বয়ে বিশাল আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।

মেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সম্প্রতি প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পলাশ চৌধুরী বলেন, ‘এই মেলাটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে মেলা কমিটি প্রস্তুতি নিচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সর্বশ্রেণি পেশার মানুষকে নিয়ে উপজেলা পরিষদে মতবিনিময়ের পর গত সোমবার চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়েও সভার মাধ্যমে প্রস্তুতি ও দিক নির্দেশনা নেওয়া হয়েছে।’

সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. ইফতেখার হাসান বলেন, ‘এই মেলা এত বিশাল যে এটি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা প্রশাসনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তবে পুলিশ, র‌্যাব, আনসারসহ বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।’ কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই এবার মেলা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে শেষ করার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।

মেলা কার্যকরী কমিটির সভাপতি সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘মেলাটি শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নেই। এটি একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। মেলা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। মেলায় যাত্রীদের সেবায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি সব সেবা প্রস্তুত রাখা হবে। এছাড়া কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক খবরাখবর নিয়ে যাত্রীদের যেকোনো প্রয়োজনে আমরা পাশে থাকব। আশা করছি অতীতের মতো এবারও মেলাটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে।’